ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো সংগঠন। পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপকরণাদিকে সঠিকভাবে সংগঠিত করার প্রয়োজন পড়ে । ভূমি, শ্রম ও মূলধন - এ তিনটি উপাদান উৎপাদনের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও তা আলাদা আলাদাভাবে কোনো উৎপাদন করতে অক্ষম। একটা প্রতিষ্ঠানেও মানুষ, যন্ত্রপাতিসহ নিয়োজিত উপকরণাদি পৃথকভাবে কোনো কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না । যখন এগুলোকে সংঘবদ্ধ করে নিয়োজিত প্রত্যেক ব্যক্তি ও বিভাগের কাজ, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব ভাগ করে দেয়া হয় ও একের সাথে অন্যের সম্পর্ক নির্ণীত হয় তখন তা একটা কাঠামোর সৃষ্টি করে ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। এভাবে সংঘবদ্ধ করার কাজকেই সংগঠিতকরণ বা সংগঠন বলে । একটা ছোট প্রতিষ্ঠানে যেভাবে সংগঠন কাঠামো গড়ে তোলা হয় একটা বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানে সেভাবে সংগঠন কাঠামো গড়ে তুললে চলে না । একটা উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠান এবং বিক্রয়ধর্মী প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোতেও ভিন্নতা লক্ষণীয় । প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বা চালাতে ইচ্ছুক প্রত্যেক ব্যক্তিরই সংগঠন ও সংগঠন কাঠামো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন অত্যাবশ্যক ।
১. সংগঠিতকরণ ও সংগঠনের ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
২. আদর্শ সংগঠনের বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
৩. সংগঠিতকরণ ও সংগঠনের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করতে পারবে ।
৪. উত্তম সংগঠনের নীতিমালা বর্ণনা করতে পারবে ।
৫. সংগঠন কাঠামোর ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
৬. বিভিন্ন ধরনের সংগঠন কাঠামোর ধারণা ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
৭. সরলরৈখিক, সরলরৈখিক ও পদস্থ, কার্যভিত্তিক, কমিটি ও মেট্রিক্স সংগঠনের ধারণা, বৈশিষ্ট্য এবং সুবিধা সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
৮. সংগঠন কাঠামো প্রণয়নের বিবেচ্য বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে পারবে ।
সরলরৈখিক
সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী
কার্যভিত্তিক
মেট্রিক্স
i ও ii
i ও iii
ii ও iii
i, ii ও iii
সবাইকে বহিষ্কার
কমিটি গঠন
নতুন কর্মী নিয়োগ
কর্মীদের বদলি
সংগঠিতকরণের সমার্থক শব্দ হলো সুসংবদ্ধকরণ, গঠনকরণ, নির্মাণ, সংগঠন ইত্যাদি । অর্থাৎ বিভিন্ন উপাদানকে বা আলাদা আলাদা কোনোকিছুকে যখন একত্রে সুসংবদ্ধ ও সম্পর্কযুক্ত করা হয় তখন তাকে সংগঠিতকরণ বলে । কাজ বিবেচনায় সংগঠন ও সংগঠিতকরণ একই অর্থে ব্যবহৃত হয় । অন্যদিকে গুণ বা ভাব অর্থে কিছু লোক মিলে গড়ে তোলা দল বা প্রতিষ্ঠানকে সংগঠন বলে । কিছু লোক যখন একই উদ্দেশ্যে একত্রিত হয় তখন তাদের মধ্যে একটা সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। সেখানে কেউ নেতা ও কেউ অনুসারী বা কেউ ঊর্ধ্বতন (Boss) ও কেউ অধস্তন (Subordinate) হিসেবে কাজ করে । এক্ষেত্রে প্রত্যেকের কাজ, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় । কে কার নিকট থেকে কাজের নির্দেশ লাভ করবে ও কার নিকট জবাবদিহি করবে তাও বলে দেয়া হয় । এভাবে সংঘবদ্ধ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে একটা সম্পর্কের কাঠামো গড়ে ওঠে । সংঘবদ্ধ ব্যক্তিবর্গের মধ্যকার এরূপ সম্পর্কের কাঠামোকে তাই সংগঠন নামে অভিহিত করা হয় ।
'Organising' শব্দটি 'Organism' হতে এসেছে। যার অর্থ হলো কোনো পৃথক সত্তাবিশিষ্ট অংশগুলোকে এতখানি সমন্বিত করা যার ফলে প্রত্যেক অংশের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে সামগ্রিক (Whole) কোনো কিছুর সৃষ্টি হয় । শিশুরা যেমন কতকগুলো প্লাস্টিকের বিল্ডিং তৈরির উপযোগী ছোট ছোট অংশকে একত্রে জুড়ে দিয়ে খেলনা বাড়ি তৈরি করে, একজন সংগঠকও তেমনি বিভিন্ন উপায়-উপকরণকে একত্রিত করে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে । খেলনার ছোট ছোট অংশ হতে কার্যত কোনো কিছুই অনুমান করা যায় না, কিন্তু যখন এগুলোকে একত্রে জুড়ে দিয়ে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করা হয়, তখনই তা একটা বাড়ির রূপ ধারণ করে । ঠিক একইভাবে একটি প্রতিষ্ঠানে উপায়-উপকরণ যা থাকে তা আলাদাভাবে কোনো কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না। যখন এগুলোকে কাজ অনুযায়ী আলাদা ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক কাজের জন্য উপায়-উপকরণ নির্দিষ্ট করা হয় এবং এ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের দায়-দায়িত্ব ও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় তখন তা লক্ষ্য অর্জনের জন্য উপযোগী একটা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের রূপলাভ করে । তাই উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজকে বিভাজন, প্রতিটা বিভাগের দায়িত্ব-কর্তৃত্ব নির্দিষ্টকরণ ও অর্পণ এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট করার কাজকেই সংগঠন নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে ।
সংগঠন হলো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত মানবীয় ও বস্তুগত উপকরণাদিকে সংহত ও সঠিকভাবে কাজে লাগানোর একটি প্রক্রিয়া। L. A. Allen বলেছেন, 'সংগঠন হলো একটি প্রক্রিয়া যা উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য আবশ্যকীয় কার্যাদি শনাক্তকরণ ও শ্রেণিবদ্ধকরণ, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সংজ্ঞায়িতকরণ ও বণ্টন এবং কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের সাথে সম্পর্কিত।” উপরোক্ত সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে সংগঠন প্রক্রিয়ার যে সকল পদক্ষেপ লক্ষণীয় তা নিম্নে রেখাচিত্রের সাহায্যে তুলে ধরা হলো :
ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. কার্য বিভাজন বা বিভাগীয়করণ (Departmentation of jobs) : ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার প্রথম কাজ বা পদক্ষেপ হলো কার্যাদি সঠিকভাবে শনাক্ত বা নির্দিষ্ট করে তা প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা । কাজ সঠিকভাবে চিহ্নিত ও ভাগ করা না হলে উপযুক্ত কর্মীসংস্থান ও দায়িত্ব অর্পণ সম্ভব হয় না । ধরা যাক, সজীবকে একটি ক্লাব সংগঠনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে । তাহলে সজীবের প্রথম কাজ হবে ক্লাবের উদ্দেশ্য বুঝে কী কী কাজ করতে হবে তা নির্দিষ্টপূর্বক কাজগুলোকে প্রধান প্রধান কতকগুলো ভাগে ভাগ করা; যেমন -অফিস বিভাগ, ক্রীড়া বিভাগ, সংস্কৃতি বিভাগ ইত্যাদি ।
২. দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সংজ্ঞায়িতকরণ (Defining authority and responsibility) : কাজ ভাগ করার পর সংগঠন প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রত্যেক কাজের জন্য দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের সীমারেখা নির্দিষ্ট করা । উৎপাদন বিভাগ এবং ক্রয় বিভাগ পাশাপাশি থাকলে যদি প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব ঠিক করে দেয়া না হয়, কোন মালামাল কোন বিভাগ ক্রয় করবে এ বিষয়ে যদি সুস্পষ্ট কর্তৃত্ব ভাগ না থাকে তবে কার্যক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়া স্বাভাবিক । প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট থাকলে সে অনুযায়ী প্রত্যেককে জবাবদিহি করা সহজ হয় । ফলে ফাঁকিবাজী, অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানো ইত্যাদির সুযোগ থাকে না ।
৩. দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ (Delegation of authority and responsibility) : দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের সীমারেখা নিরূপণের পর সংগঠন প্রক্রিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপ হলো প্রত্যেক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, বিভাগ বা উপবিভাগকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বুঝিয়ে দেয়া । এক্ষেত্রে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সব সময়ই সমান হওয়া উচিত । প্রত্যেক ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেয়া হলে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যায় । সেই সাথে প্রত্যেকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী কাজ করতে সচেষ্ট হয়। ফলে কার্যক্ষেত্রে দক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি পায় ।
৪. পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ (Determining interpersonal relation) : সংগঠন প্রক্রিয়ার সর্বশেষ ধাপ হলো প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগ ও ব্যক্তির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা। এক্ষেত্রে কে কার ঊর্ধ্বতন এবং কে কার অধস্তন তা ঠিক করা হয় । কে কার নিকট থেকে নির্দেশ লাভ করবে ও কার নিকট জবাবদিহি করবে তা বলে দেয়া হয় । তবে এক্ষেত্রে যাতে কখনই দ্বৈত অধীনতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন ।
উপরোক্ত পদক্ষেপসমূহ ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করে কার্যকর সংগঠন গড়ে তোলা হয় । সংগঠন কাঠামো মজবুত ও শক্তিশালী হলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও উপায়-উপকরণের কার্যকর ব্যবহার সম্ভব হয়ে থাকে ।
মিসেস নাসরীন বড় চাকরি করেন । বাসা-বাড়ির কাজে তেমন সময় দিতে পারেন না । তাই তিনটা কাজের মেয়ে রেখেছেন । তারা কাজ নিয়ে প্রায়শই ঝগড়া করে । কোনো কাজ কেন হয়নি জিজ্ঞাসা করলে একজন আরেকজনের ওপর দোষ চাপায় । সারাদিন পর অফিস থেকে ফিরে কাজের মেয়েদের ঝগড়া মিটাতেই তার নাভিশ্বাস । তিনি এ সমস্যাটা তার বান্ধবী মিসেস চৌধুরীকে বললেন । বান্ধবীর পরামর্শ, প্রত্যেকের কাজ আলাদা আলাদা করে ভাগ করে দাও। কে ঘর-দোর, হাড়ি-পাতিল পরিষ্কার করবে, কে কাপড়-চোপড় ধোয়া ও ঘর-দোর গুছানোর কাজ করবে এবং কে রান্নাবান্না করবে- এটা ঠিক করে দিলে দেখবে কাজও ভালো হচ্ছে, ঝগড়াও কমে গেছে । সম্ভব হলে তিনজনের মধ্যে যে একটু বয়স্ক ও অন্যদের চালাতে পারবে- তাকে অন্য দু'জনের ওপর দায়িত্বশীল করে দাও । সেক্ষেত্রে তুমি যাকে দায়িত্ব দিয়েছো তার সাথে যোগাযোগ করে কাজ সম্পর্কে খোঁজ- খবর নিতে পারবে । মিসেস চৌধুরীর কথামতো কাজ করে মিসেস নাসরীন ভালো ফল পাচ্ছেন। একটা বাসা- বাড়িতে তিনজনের কাজ ভাগ করে তাদের সংগঠিত না করলে যদি সমস্যা হয় তবে যেখানে নানান মানের শত শত কর্মী কাজ করে তাদেরকে সঠিকভাবে সংগঠিত করে কাজ, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বুঝিয়ে দিতে না পারলে সঠিকভাবে কাজ বুঝে নেয়া বা শৃঙ্খলার সাথে কাজ পরিচালনা করা কখনই সম্ভব নয় । তাই সংগঠিত করার বা সংগঠনের বেশ কিছু গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকলেই তাকে আদর্শ সংগঠন হিসেবে গণ্য করা যায় । এরূপ সংগঠনের কতিপয় গুণ বা বৈশিষ্ট্য নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. উদ্দেশ্যকেন্দ্রিকতা (Objects oriented) : প্রতিষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্যকে ঘিরে কোনো কার্যক্রম পরিচালিত হওয়াকেই উদ্দেশ্যকেন্দ্রিকতা বলে । একটি উত্তম সংগঠনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি এমনভাবে বিন্যস্ত ও সংহত করা হয় যাতে তা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য অর্জনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। উৎপাদনধর্মী একটি প্রতিষ্ঠানকে যেভাবে সংগঠিত করা হয় একটি সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সংগঠনকে সেভাবে সংগঠিত করলে চলে না । একটি সামরিক ও একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে একইভাবে সাজানো হয় না । তাই একটি ভালো সংগঠনে এর কার্য বিভাজন, দায়িত্ব-কর্তৃত্ব নির্ধারণ ও পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণে এর উদ্দেশ্যকে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে ।
২. সহজবোধ্যতা (Easy understanding) : সহজে চেনা যায়, বোঝা যায় বা ধারণা লাভ করা যায় কোনো বিষয়ের এমন গুণকেই সহজবোধ্যতা বলে । একটি উত্তম সংগঠনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি যতদূর সম্ভব সহজবোধ্য হতে হয় । একটি সংগঠন চার্ট দেখে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরের যে কেউ যাতে এর ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত বিভিন্ন পদ, পারস্পরিক সম্পর্ক, কর্তৃত্ব শৃঙ্খল (Chain of command) ইত্যাদি বিষয়ে ধারণা পেতে পারে-একটি উত্তম সংগঠনে তা নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। সংগঠন জটিল হলে সেখানে আদেশ দান, যোগাযোগ, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণে সব সময়ই সমস্যা দেখা দেয় এবং এর ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক কার্যধারা বজায় রাখা সম্ভব হয় না।
৩. বিশেষায়ণের সুযোগ (Opportunity of specialization): বিশেষ কাজে কর্মীর বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনের সুযোগকেই বিশেষায়ণের সুযোগ বলে । একটা উত্তম সংগঠনে প্রতিষ্ঠানের কাজগুলোকে এমনভাবে বিভাজন করা হয় যাতে বিশেষায়ণের সুযোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে । প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী যদি একটা কাজ করে তবে সে ঐ একক কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে । কিন্তু তাকে যদি একই সাথে একাধিক কাজ দেয়া হয় তবে তার পক্ষে কোনো কাজেই যথেষ্ট জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয় না । তাই সংগঠনে কার্য বিভাজন এবং দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণকালে এ বিষয়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়ে থাকে ।
৪. সুসংজ্ঞায়িত দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব (Well-defined responsibility and authority) : কর্তৃত্ব হলো আদেশ দানের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব হলো জবাবদিহি করার বাধ্য-বাধকতা । কোনো ব্যক্তি বা বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব কতটা— তার সুস্পষ্ট বর্ণনা ও যথাযথ অনুসরণ একটি ভালো সংগঠনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য । প্রতিষ্ঠান যতো বড় হয় বা এর কাজ যতো জটিল হয় ততোই সেখানে বিভিন্ন ধরনের বিভাগ প্রতিষ্ঠা ও ব্যক্তি নিয়োগের প্রয়োজন পড়ে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি ও বিভাগের দায়িত্ব-কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করা না হলে ভুল বোঝাবুঝি ও জটিলতা সৃষ্টির সমূহ সম্ভাবনা থাকে । তাই একজন ভালো সংগঠক তার প্রতিষ্ঠানের ওপর হতে নিচ পর্যন্ত সকল পদে কর্মরত ব্যক্তিদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করার প্রয়াস পেয়ে থাকেন ।
৫. ভারসাম্যপূর্ণ (Well-balancing) : কাজের ভারে এবং দায়িত্ব-কর্তৃত্বের মাত্রায় সামঞ্জস্য বিধানের গুণকেই ভারসাম্যপূর্ণ বলে। একটি উত্তম সংগঠনকে অবশ্যই ভারসাম্যপূর্ণ হতে হয়। এক্ষেত্রে বিভাগ ও উপবিভাগ এমনভাবে খোলা হয় যাতে প্রত্যেকটি বিভাগই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও একে অন্যের সহযোগী হয়ে উঠতে পারে । প্রত্যেকেই পরিমিত কাজ পায় । কোনো ব্যক্তি বা বিভাগ কর্মভারগ্রস্ত আবার কারও তেমন কোনো কাজ নেই এমন অবস্থার সুযোগ উত্তম সংগঠনে থাকে না। এ ছাড়া একটি উত্তম সংগঠনে কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যেও ভারসাম্য বজায় থাকে। অধিক কেন্দ্রীকরণ যেনো কাউকে স্বেচ্ছাচারী না করে এবং অধিক বিকেন্দ্রীকরণ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণ না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য বিধান করা হয়ে থাকে ।
৬. আনুগত্য ও শৃঙ্খলা (Loyalty and discipline) : অন্যের বশ্যতা স্বীকার বা বাধ্যতার গুণকে আনুগত্য বলে । অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি মান্য করে চলা শৃঙ্খলা হিসেবে গণ্য । একটি কার্যকর সংগঠনে আনুগত্য ও শৃঙ্খলার ভাবধারা সব সময়ই বজায় থাকে । প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট থাকায় প্রত্যেকেই যার যার কাজ সম্পাদন করে । কেউ কোনোরূপ ফাঁকি দিলে সাংগঠনিক নিয়মের কারণে তা সহজেই ধরা পড়ে যায় । জবাবদিহিতা করাও দ্রুত ও সহজ হয় । ফলে কার্যক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার কোনোই সুযোগ থাকে না । প্রতিষ্ঠানে 'জোড়া-মই-শিকল' নীতি অনুসরণ করায় প্রত্যেকেই অন্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দায়িত্ব পালন করে । উপর হতে নিচের দিকে পর্যায়ক্রমে কর্তৃত্বরেখা প্রবাহিত হওয়ায় প্রত্যেকেই তার ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ মান্য করতে বাধ্য থাকে । ফলে আনুগত্যহীনতার সুযোগ থাকে না ।
সংগঠন হলো ইঞ্জিন সদৃশ । ইঞ্জিন অচল হলে ড্রাইভার, বডি বা বগির যেমন কার্যকারিতা থাকে না তেমনি একটা প্রতিষ্ঠানে সংগঠন বা সংগঠিতকরণের কাজ সুষ্ঠুভাবে না হলে তা চলতে পারে না। মনে করি একটা উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বিভাগ খোলা হয়েছে কিন্তু বিক্রয় বিভাগ খোলা হয়নি বা বিক্রয় বিভাগ খোলা হয়েছে কিন্তু তার অধীনে জেলা বা আঞ্চলিক বিক্রয় কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়নি । তাহলে প্রধান অফিসের পক্ষে ৬৪টি জেলার বিক্রয় কাজ সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান ও বিক্রয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না । প্রত্যেক ব্যক্তি ও বিভাগের কাজ, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব সঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয়া যেমনি জরুরি তেমনি একের সাথে অন্যের সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে দেয়ারও প্রয়োজন পড়ে। এতে কে কার নিকট জবাবদিহি করবে, আদেশ লাভ করবে-এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এতে সংগঠনে কর্তৃত্ব রেখা ও যোগাযোগ প্রবাহ সম্পর্কে প্রত্যেকে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারে । অতঃপর কোনো নির্দেশ দিলে তা যথানিয়মে সংশ্লিষ্টদের নিকট পৌঁছে ও তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় । এভাবে নির্দেশ দান ও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে একটা প্রতিষ্ঠান সচল থাকে ও গতিশীলতা লাভ করে। তাই একটি প্রতিষ্ঠানে যদি উদ্দেশ্য অর্জনের উপযোগী করে একটা সংগঠন কাঠামো তৈরি এবং সে অনুযায়ী কাজ ও উপায়-উপকরণ সংহত করা সম্ভব না হয় তবে ব্যবস্থাপনার অন্যান্য সকল কাজ কখনই লক্ষ্য অর্জন করতে পারে না । নিম্নে বিভিন্ন দিক হতে সংগঠনের গুরুত্ব তুলে ধরা হলো:
১. উদ্দেশ্যার্জনে সহযোগিতা (Aid to accomplishment of objective ) : ব্যবস্থাপনা সংগঠনে প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি এর প্রকৃতি বা অন্য কোনো সুবিধাজনকভাবে ভাগ করে এর প্রত্যক ভাগের দায়িত্ব নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ওপর অর্পণ করা হয় । কার্যকর শ্রমবিভাগ প্রতিষ্ঠার ফলে নির্বাহীগণ স্ব-স্ব কার্যক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতে পারে । প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্দিষ্ট থাকায় প্রত্যেকেই স্বাচ্ছন্দ্য সহকারে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনে উদ্বুব্ধ হয় । ফলে প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যার্জন সহজতর হয়ে থাকে ।
২. উপকরণের যথাযথ ব্যবহার (Effective utilization of resources) : একটি কার্যকর সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত মানবীয় ও বস্তুগত সকল উপকরণের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় । এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের কাজকে সঠিকভাবে ভাগ করে প্রত্যেকটি কাজ বা বিভাগের জন্য কোন্ মানের জনশক্তি ও উপায়-উপাদানের প্রয়োজন হবে তা নির্ণীত হয়। এ ছাড়া প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের সীমা নির্ধারণপূর্বক কে কার নিকট জবাবদিহি করবে তাও ঠিক করে দেওয়া হয়। এর ফলে জনশক্তিসহ সকল উপকরণের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
৩. বিশেষীকরণে সহায়তা (Aid to specialization) : প্রতিষ্ঠানে একটি কার্যকর ব্যবস্থাপনা সংগঠন বিশেষায়ণ ও শ্রম বিভাগের নীতির মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়। একজন কর্মীর জন্য একই ধরনের কাজ নির্দিষ্ট করার প্রয়াস চালানো হয় । এতে কর্মীর দক্ষতা বৃদ্ধি পায় । ফলে মিতব্যয়িতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ সম্পাদন সম্ভব হয় । এভাবে কার্য সম্পাদনের ফলে প্রত্যেক বিভাগ ও উপবিভাগের কার্যদক্ষতা বাড়ে, নির্বাহীর পক্ষে তত্ত্বাবধান সহজ হয় এবং কাজের মানও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে ।
৪. সহজ সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ (Smooth co-ordination and control) : সংগঠন কাঠামো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের উপর হতে নিচ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বিভাগ ও উপবিভাগের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্দিষ্টের পাশাপাশি এদের মধ্যকার সম্পর্কও নির্ণীত হয়। এ ছাড়া কার্যকর সংগঠন প্রতিষ্ঠায় 'জোড়া-মই-শিকলের' নীতি অনুসৃত হয়। এক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি ও উপায়-উপাদানকে একে অন্যের সহযোগী করে তোলার চেষ্টাও করা হয়ে থাকে । ফলে প্রত্যেক বিভাগ ও উপবিভাগের মধ্য স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এবং সর্বস্তরে সমন্বিত কার্যব্যবস্থা পরিচালিত হয় ।
৫. সৃজনশীলতার বিকাশ (Development of creativity) : উত্তম ও শক্তিশালী সংগঠন কাঠামো বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত নির্বাহী ও কর্মীদের উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে । যথোপযুক্ত কর্তৃত্ব লাভে যেমনি কর্মী বা নির্বাহী সন্তুষ্ট হয় তেমনি পূর্বে বর্ণিত দায়িত্ব তাকে নিজ যোগ্যতা অর্জনে উৎসাহিত করে । প্রত্যেকের কর্তৃত্ব সীমা নির্দিষ্ট থাকায় নিজ কর্তৃত্ব সীমার মধ্যে কিভাবে সুন্দররূপে দায়িত্ব পালন করা যায় নির্বাহী বা কর্মী তা চিন্তা করে । এ ছাড়া সংগঠন কাঠামোতে পদোন্নতির গতিপথ পূর্বনির্দিষ্ট থাকায় কর্মীও সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলে । এতে তার সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটে ।
৬. কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা (Establishing effective leadership) : কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যবস্থাপনা সংগঠনের ভূমিকা অনস্বীকার্য । এরূপ নেতৃত্ব সৃষ্টি নির্ভর করে প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলির কার্যকর বিভাজন, দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের সুস্পষ্ট বর্ণনা, কেন্দ্রীকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বিধান, আনুগত্যের ভাবধারা প্রতিষ্ঠা ও জবাবদিহিতার মতো পরিবেশ সৃষ্টির ওপর। এ ছাড়া কাজের চাপকে একটা কাম্য মাত্রায় ধরে রাখার বিষয়টিও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । উত্তম সংগঠনই মাত্র এ সকল সুযোগ নিশ্চিত করে কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারে ।
৭. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা (Establishing discipline) : সাংগঠনিক শৃঙ্খলা যেকোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে গণ্য । এরূপ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা সংগঠনের বিশেষ গুরুত্ব লক্ষণীয় । কার্য বিভাজন, দায়িত্ব-কর্তৃত্ব নিরূপণ, কে কার অধীন, কে কার ঊর্ধ্বতন, কে কার কাছ থেকে নির্দেশ পাবে এবং কার কাছে কাজের জন্য জবাবদিহি করবে ইত্যাদি বিষয় যদি সঠিকভাবে পূর্বেই নির্ধারণ করা না হয়, বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগের মধ্যে সম্পর্ক কী হবে তা নিয়ে যদি সমস্যা থাকে তবে কার্যক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় । কার্যকর সংগঠনের মাধ্যমেই এরূপ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা যায় ।
নীতি হলো কোনো কাজ সম্পাদনের সাধারণ নির্দেশিকা (Guidance for action)। দীর্ঘ দিনের কার্য প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সকল ক্ষেত্রেই এমন কিছু নিয়ম-নীতি গড়ে ওঠে বা গৃহীত হয় যা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হলে ঐ কাজ সুচারুরূপে সম্পাদন করা যায়। এ ধরনের নিয়ম বা দিক-নির্দেশনাকেই নীতি বলা হয়ে থাকে। কার্যকর সংগঠন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এমন কিছু নিয়ম-রীতি বা নীতিমালা লক্ষণীয় । নিম্নে তা তুলে ধরা হলো :
১. লক্ষ্যের নীতি (Principle of goals) : প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য সামনে রেখে সংগঠন গড়ে তোলার নীতিকেই লক্ষ্যের নীতি বলে । কার্যকর সংগঠন প্রতিষ্ঠায় একজন সংগঠককে প্রথমেই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বিবেচনা করতে হয়। লক্ষ্য যেমন হবে সংগঠনকেও সেভাবেই গড়ে তোলা আবশ্যক । এলাকার উন্নয়নে একটা ক্লাব গড়তে যেয়ে সংগঠনকে যেভাবে তৈরি করার প্রয়োজন হয় একটা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের সংগঠনকে সেভাবে গঠন করলে চলে না। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও একটি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও এ কারণেই সংগঠন কাঠামোতে ভিন্নতা লক্ষ করা যায় ।
২. দক্ষতার নীতি (Principle of efficiency) : কমশক্তি ও উপায়-উপকরণ ব্যয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের নীতিই হলো দক্ষতার নীতি। ব্যবস্থাপনা সংগঠন প্রতিষ্ঠায় দক্ষতার বিষয়টি সবসময়ই সামনে রাখতে হয়। সংগঠনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কার্য প্রবাহের গতিপথ রচিত হয়ে থাকে । যেখানে যে বিভাগ খোলা প্রয়োজন, দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব প্রত্যেকের জন্য যেভাবে নির্ধারণ করা উচিত, সম্পর্ককে যেভাবে ঠিক করে দেওয়া আবশ্যক তা যদি করা না যায় তাহলে পরবর্তী সময়ে যতো নিষ্ঠা সহকারে কাজ করা হোক না কেন দক্ষতাসহকারে তা সম্পাদন ও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ সম্ভব হয় না ।
৩. কাম্য পরিসর নির্ণয়ের নীতি (Principle of determining optimum span of supervision) : একজন নির্বাহীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাম্য সংখ্যক অধস্তন ন্যস্ত করার নীতিকেই কাম্য পরিসর নির্ণয়ের নীতি বলে । প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে নিযুক্ত প্রত্যেক নির্বাহী বা ব্যবস্থাপকগণ প্রত্যক্ষভাবে কতজন অধস্তনের কাজ তত্ত্বাবধান করবেন তা সংগঠন কাঠামোতে নির্দিষ্ট করা হয় । এক্ষেত্রে একজন নির্বাহীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এমন পরিমাণ নির্বাহীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করা উচিত যাতে তার পক্ষে অধস্তনদের কাজ সঠিকভাবে তত্ত্বাবধান করা যায় । এ লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানের উপরিস্তরে তত্ত্বাবধান পরিসর ছোট এবং নিচের দিকে তত্ত্বাবধান পরিসর কিছুটা বড় রাখতে হয় ।
৪. জোড়া-মই-শিকলের নীতি (Principle of scalar-chain) : প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত সকল ব্যক্তি ও বিভাগকে একে অন্যের সাথে সংযুক্ত করার নীতিকেই জোড়া-মাই-শিকলের নীতি বলে । একটি মজবুত ব্যবস্থাপনা সংগঠনে জোড়া মই-শিকলের নীতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ উপর থেকে শুরু করে নিচ পর্যন্ত প্রত্যেক বিভাগ, উপবিভাগ ও ব্যক্তির কাজকে এমনভাবে একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় যাতে কেউই এর বাইরে না থাকে । এরূপ শিকল প্রতিষ্ঠার ফলে কর্তৃত্ব প্রবাহ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় । এতে আদেশ দান ও এর বাস্তবায়ন সহজ হয় এবং দলীয় প্রচেষ্টা জোরদার হয় ।
৫. দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণের নীতি (Principle of defining specific responsibility) : দায়িত্ব হলো কর্ম সম্পাদন বা কর্তব্য পালনের দায়। ব্যক্তি ও বিভাগের কর্ম বা কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিয়ে দায় পালনযোগ্য ও জবাবদিহিতামূলক করার নীতিকেই দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণের নীতি বলে। ব্যবস্থাপনা সংগঠনে কর্মরত প্রত্যেক বিভাগ, উপবিভাগ ও কর্মীর দায়িত্ব নির্দিষ্ট থাকা আবশ্যক । প্রত্যেকেই যেনো জানতে পারে তার দায়িত্ব ও কর্তৃত্বের সীমা কতদূর । প্রতিষ্ঠানের উপরিস্তরের নির্বাহীদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বেশি হয় এবং ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে তা কম হতে থাকে । এতে ঊর্ধ্বতন অধিক কর্তৃত্বশালী হয়। ফলে সে যেমনি অধস্তনদেরকে জবাবদিহি করাতে পারে তেমনি নিজেও জবাবদিহির সম্মুখীন হবে বাধ্য থাকে । এছাড়া কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের মধ্যে সবসময়ই সমতা বিধান অপরিহার্য ।
৬. আদেশের ঐক্য নীতি (Principle of unity of command) : একজন কর্মীর আদেশদাতা হবে একজন মাত্র ব্যক্তি - এটা নিশ্চিত করার নীতিকেই আদেশের ঐক্য নীতি বলে । সংগঠন প্রতিষ্ঠাকালে এমনভাবে দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব বণ্টন করা উচিত যেনো কোনো ক্ষেত্রেই দ্বৈত অধীনতার সৃষ্টি না হয় । অর্থাৎ একজন অধস্তনের যাতে প্রত্যক্ষভাবে একজন মাত্র আদেশকর্তা (Boss) থাকে এবং কোনো কর্মীকেই যেনো তার কাজের রিপোর্ট একাধিক ঊর্ধ্বতনের নিকট পেশ বা জবাবদিহি করতে না হয়। একাধিক আদেশদাতা থাকলে দ্বৈত অধীনতার সৃষ্টি হয় এবং সে অবস্থায় অধস্তনের পক্ষে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হয় না ।
৭. সারল্য ও সুস্পষ্টতার নীতি (Principle of simplicity and clarity) : সংগঠন কাঠামোচিত্র দেখেই যেন এর বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগ, কর্তৃত্ব প্রবাহ ইত্যাদি সম্পর্কে সহজে বোঝা যায় এবং দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব যেনো সবাই সহজে বুঝে নিতে পারে- এটা নিশ্চিত করার নীতিকেই সারল্য ও সুস্পষ্টতার নীতি বলে । ব্যবস্থাপনা সংগঠন এমন হওয়া আবশ্যক যাতে তা সহজ ও সরল হয় । এরূপ সংগঠন কাঠামো দেখে সংগঠনের ভিতরে ও বাইরের যে কেউ যেন এর স্তর বিন্যাস, কর্তৃত্বরেখা এবং জনশক্তি ও বিভাগ সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে। প্রত্যেকেই যেন তার ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন সম্পর্কে এবং নিজস্ব দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করতে সমর্থ হয় ।
৮. বিশেষায়ণের নীতি (Principle of specialization) : বিশেষ কাজে কর্মীর বিশেষ জ্ঞান বা দক্ষতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কর্ম বিভাজন ও দায়িত্ব অর্পণের নীতিকেই বিশেষায়ণের নীতি বলে । বিশেষায়ণ বলতে কাজকে সুষ্ঠুভাবে বিভাজন করে একজন কর্মীর জন্য একটি কাজ নির্দিষ্ট করাকে বুঝায় যাতে সে একই ধরনের কাজ করতে গিয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায় । এতে কর্মীর কার্যদক্ষতা বাড়ে এবং প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরে কাজের গতিশীলতা বজায় রাখা সহজ হয় । কার্য বিভাজনকালে এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্বারোপ করা উচিত ।
মি. রায়হান রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চাকরি করেননি । প্রথমে কয়েকজন কর্মী সাথে নিয়ে তিনি একটা ছোট কসমেটিক্স সামগ্রী তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। প্রথমে নিজেই কর্মীদের কাজ দেখেছেন । উৎপাদিত পণ্য দোকানে ঘুরে ঘুরে বিক্রয় করেছেন। তার উৎপাদিত পণ্যের মান ও এর সুগন্ধ দ্রুতই ক্রেতাদের নজর কাড়ায় তার ব্যবসায় দ্রুত বাড়তে থাকে । এক পর্যায়ে উৎপাদনের কাজ দেখার জন্য তিনি একজন জুনিয়র কেমিস্ট নিয়োগ করেন। বিক্রয় দেখার জন্য বিবিএ পাস করা একজন গ্রাজুয়েটকে দায়িত্ব দেয়া হয় । পরে উৎপাদিত পণ্যের মান নিশ্চিত করার জন্য কোয়ালিটি কন্ট্রোল অফিসার এবং বিক্রয় কার্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে মার্কেটিং বিভাগ খুলে তার অধীনে সেলস প্রমোশন অফিসার নিয়োগ করেন । এখন তার কারখানা অনেক বড় হয়েছে । নতুন নতুন আধুনিক যন্ত্র বসেছে। সারা দেশে পরিবেশক নিয়োগ দিয়েছেন । প্রশাসনিক বিভাগ, মানবসম্পদ বিভাগ, ক্রয় বিভাগ, অর্থ বিভাগ ইত্যাদি খুলে বিভিন্ন যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে । এখন তিনি প্রতিষ্ঠানের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO) । এভাবে তার প্রতিষ্ঠানে ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ধাপে ব্যবস্থাপক ও কর্মী মিলে একটা শক্তিশালী ও দৃশ্যমান সম্পর্কের রূপরেখা গড়ে উঠেছে । যেই সম্পর্কের মূলকেন্দ্রে আছেন তিনি। আর তা ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিভাগ ও উপবিভাগে ভাগ হয়ে নিচের দিকে বিস্তৃত হয়েছে । মি. রায়হান ভাবেন, একটা বিল্ডিং যেভাবে ধীরে ধীরে নির্মিত হয়ে একটা বৃহৎ অবকাঠামোতে রূপ নেয় আজ তার শিল্পও ধীরে ধীরে এ ধরনের একটা কাঠামোর রূপ নিয়েছে । প্রথমে তিনি স্বল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে যেই প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন সেখানেও একটা কাঠামো ছিল । কিন্তু আজ তা সত্যিই দৃশ্যমান । মি. রায়হানের প্রতিষ্ঠানে যে সম্পর্কের কাঠামো আমরা অনুমান করতে পারি তাকেই সংগঠন কাঠামো বলে । যদি তা একটা চিত্রে তুলে ধরা হয় তবে তাকে সংগঠন কাঠামো চিত্র (Organogram) বলা হয়ে থাকে ।
সংগঠন কাঠামো হলো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন বিভাগ, উপবিভাগ ও কর্মীবৃন্দের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি কাঠামো চিত্র । সংগঠন কাঠামোকে যখন একটি চিত্রে উপস্থাপন করা হয় তখন ঐ চিত্রকে সংগঠন চার্ট নামে অভিহিত করা হয়। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্তর, বিভাগ, উপবিভাগ এবং ক্ষমতা প্রবাহের চিত্র প্রদর্শিত হয় ।
সংগঠন কাঠামোর আয়তন-এর কাজ ও কর্মীর সংখ্যা এবং এর স্তর বিন্যাসের ওপর নির্ভরশীল । স্তর বিন্যাস যত বৃদ্ধি পায় সংগঠন কাঠামোর আয়তনও ততো বাড়ে। সংগঠন চিত্র ততোই ওপরের একক কেন্দ্র হতে নিচের দিকে বিস্তৃতি লাভ করে । ফলে এটি অনেকটা পিরামিডের আকৃতি পায় । নিম্নে একটা সংগঠন কাঠামো চিত্র তুলে ধরা হলো:
মি. মজুমদার একটা ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাধারণ ব্যবস্থাপক বা মুখ্য নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন বিশ বছর আগে । তখন তার অধীনে উৎপাদন ও বিক্রয় বিভাগের দু'জন ব্যবস্থাপক অধীনস্থ নির্বাহী হিসেবে কাজ করতেন । উৎপাদন ব্যবস্থাপকের অধীনে ছিল দু'জন কর্মী তত্ত্বাবধায়ক ও তাদের অধীনে মোট বিশ জন শ্রমিক । বিক্রয় ব্যবস্থাপকের অধীনে তিনজন বিক্রয় তত্ত্বাবধায়ক এবং তাদের অধীনে মোট ত্রিশ জন বিক্রয়কর্মী । ছোট প্রতিষ্ঠান তাই সহজ সংগঠন কাঠামো ছিল । পরে উৎপাদন ও বিক্রয় বাড়লো । উৎপাদন বিভাগে নতুন নতুন প্লান্ট বসায় প্রতিটা প্লান্টে আলাদা ম্যানেজার নিয়োগ করা হলো । সেভাবে নিচের স্তরগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক ও শ্রমিক- কর্মীর সংখ্যা বাড়লো। বিক্রয় বিভাগে এরিয়া সেলস ম্যানেজার, সেলস সুপারভাইজার ও বিক্রয় কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো । তাই উৎপাদন ব্যবস্থাপক ও বিক্রয় ব্যবস্থাপককে সহযোগিতার জন্য প্রত্যেককে একজন করে সহকারী দেয়া হলো। তিনি নিজের অধীনেও একজন সহকারী জেনারেল ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছেন। পরবর্তীতে কাজের চাপ ও জটিলতা বাড়ায় এবং ক্ষেত্রেবিশেষে উৎপাদন ব্যবস্থাপক ও সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপকের মধ্যে দ্বন্দ্ব লক্ষ করে মি. মজুমদার উৎপাদন বিভাগের কাজকে প্রকৃতি অনুযায়ী ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে সীমিত কর্তৃত্ব সহযোগে সেখানে আলাদা আলাদা ব্যবস্থাপক নিয়োগ করেন । উৎপাদন ব্যবস্থাপককে সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (উৎপাদন) হিসেবে পদোন্নতি দেন । উৎপাদিত পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ে সমান গুরুত্ব না পাওয়ায় ব্যবসায় দু-একটা পণ্য নির্ভর হয়ে পড়েছিল । তাই তিনি প্রতিটা পণ্যকে আলাদা প্রজেক্ট ধরে নিয়ে প্রতিটা পণ্যের জন্য প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ দিয়েছেন । অন্যান্য ব্যবস্থাপকগণ কার্যিক ব্যবস্থাপক হিসেবে প্রজেক্ট ম্যানেজারকে সহায়তা করেন । এতে প্রতিটা পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় নিয়ে মি. মজুমদারকে ভাবতে হয় না। তিনি কোনো সমস্যা হলে সেখানেই শুধু হস্তক্ষেপ করেন। প্রয়োজনে সমস্যা সমাধানের জন্য অথবা সমন্বয়ের প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ঊর্ধ্বতনকে দায়িত্ব দেন । যারা সামষ্টিকভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেন । ফলে প্রতিষ্ঠান বড় হলেও মি. মজুমদার অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে তার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন । আর এটা সম্ভব হয়েছে প্রয়োজনের সাথে মিল রেখে প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোতে পরিবর্তন আনার কারণেই । তিনি যদি শুরুতে যে সংগঠন কাঠামো পেয়েছিলেন তার ওপর নির্ভর করতেন তবে কোনোভাবেই এত বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না ।
সংগঠন কাঠামো হলো প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগের পারস্পরিক সম্পর্কের কাঠামো । এরূপ সম্পর্ক সংগঠনের বিভিন্ন স্তরে নিয়োজিত ব্যক্তি ও বিভাগের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাংগঠনিক অবস্থান ও পদমর্যাদা থেকে সৃষ্ট হলে তাকে আনুষ্ঠানিক সংগঠন বলে । এর বাইরে কর্মরত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে মিল- মহব্বত, পছন্দ-অপছন্দ সামাজিক, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বিভিন্ন কারণে সম্পর্কের সৃষ্টি হলে তাকে অনানুষ্ঠানিক সংগঠন বলা হয়ে থাকে। ছোট হতে বড় বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান সমাজে কর্মরত রয়েছে। এদের প্রত্যেকের কাজের প্রকৃতিও নানান রকমের। কর্তৃত্ব এবং কর্তৃত্ব প্রবাহের ধারণাও এক নয় । তাই প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতি রেখে নানান ধরনের সংগঠন কাঠামো আমরা দেখতে পাই । নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
১. সরলরৈখিক সংগঠন (Line organization) : যে সংগঠন কাঠামোতে কর্তৃত্ব রেখা ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ স্তর হতে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে সরলরেখার আকারে নেমে আসে তাকে সরলরৈখিক সংগঠন বলে। সামরিক সংগঠনে আদেশদানের সরলরৈখিক গতিরেখার প্রতি যে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয় এবং ঊর্ধ্বতনের আদেশ অধস্তনরা যেভাবে বিনা দ্বিধায় মানতে বাধ্য থাকে, এক্ষেত্রে অনুরূপ নীতিমালা অনুসরণ করা হয় বলে একে সামরিক সংগঠনও বলা হয়ে থাকে ।
২. সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠন (Line and staff organization) : যে সংগঠন কাঠামোতে সরলরৈখিক নির্বাহীকে সহযোগিতা করার জন্য উপদেষ্টা বা বিশেষজ্ঞ কর্মীর ব্যবহার করা হয় তাকে সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠন বলে । এরূপ সংগঠন কাঠামোতে দু'ধরনের কর্মী থাকে - একদল সরলরৈখিক নির্বাহী ও অন্যদল উপদেষ্টা কৰ্মী । এক্ষেত্রে কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সরলরৈখিক নির্বাহী ভোগ করেন । অপরপক্ষে উপদেষ্টা কর্মীর কাজ হলো সরলরৈখিক নির্বাহীর কাজে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করা ।
৩. কার্যভিত্তিক সংগঠন (Functional organization) : কার্যভিত্তিক সংগঠন বলতে এমন এক ধরনের সংগঠনকে বুঝায় যেখানে ব্যবস্থাপনার কার্যাবলিকে কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে এদের এক একটিকে এক একজন বিশেষজ্ঞের ওপর ন্যস্ত করা হয় । এরূপ সংগঠনে বিশেষজ্ঞদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ না করে সরাসরি নির্বাহী হিসেবে নিয়োগ করা হয়ে থাকে । বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক এফ. ডব্লিউ. টেইলর এ ধরনের সংগঠন কাঠামোর উদ্ভাবক ।
৪. মেট্রিক্স সংগঠন (Matrix Organization) : ব্যবস্থাপনা সংগঠনের আধুনিক রূপ হলো মেট্রিক্স সংগঠন । এটি হলো মূলত বিভাগীয়করণের একাধিক পদ্ধতির মিশ্র রূপ । দ্রব্য ও কার্যভিত্তিক বিভাগীয়করণ ও ক্ষেত্রেবিশেষে অঞ্চলভিত্তিক বিভাগীয়করণের সমন্বয়ে দ্বৈত কর্তৃত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক সম্বলিত যে সংগঠন কাঠামো বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে তোলা হয় তাকেই মেট্রিক্স সংগঠন বলে । এ ধরনের সংগঠনের বৈশিষ্ট্য হলো-এক্ষেত্রে কার্যিক ব্যবস্থাপক ও প্রজেক্ট ব্যবস্থাপক- দু'ধরনের কর্তৃপক্ষ একই সঙ্গে কাজ করে ।
৫. কমিটি সংগঠন (Committee organization) : কমিটি হলো একদল লোকের সমষ্টি যাদের ওপর বিশেষভাবে কোনো নির্দিষ্ট প্রশাসনিক কার্য সমাধা করার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সাধারণত সরলরৈখিক বা সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠনে বিশেষ ক্ষেত্রে বা বিশেষ প্রয়োজনে এ ধরনের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে কাজ সম্পাদনের চেষ্টা করা হয়ে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কমিটি, পরীক্ষা কমিটি ইত্যাদি এরূপ সংগঠনের উদাহরণ ।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বৃহদায়তন ব্যবসায় জগতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন পূরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের সংগঠন কাঠামো ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো বিশেষ প্রতিষ্ঠানে বা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে কোন ধরনের সংগঠন কাঠামো ব্যবহৃত হবে তা বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে ।
যে সংগঠন কাঠামোতে কর্তৃত্ব রেখা সরলরেখার আকারে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে নেমে আসে এবং বিভিন্ন স্তরে নিযুক্ত সরলরৈখিক নির্বাহীগণ কোনো সহযোগীর সহায়তা ছাড়াই স্বীয় বিভাগের সর্বময় দায়িত্ব পালন করেন তাকে সরলরৈখিক সংগঠন বলে । এক্ষত্রে কর্তৃত্ব রেখার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিগণ স্ব স্ব ক্ষেত্রে অধস্তন ব্যক্তিবর্গের ওপর অতিমাত্রায় কর্তৃত্বশালী থাকে। সামরিক সংগঠনে আদেশদানের সরলরৈখিক গতিরেখার প্রতি যে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং উর্ধ্বতনের আদেশ অধস্তনরা বিনা দ্বিধায় মানতে বাধ্য থাকে, এরূপ সংগঠন কাঠামোতে আদেশ দান ও তা পালনে অনুরূপ নীতিমালার অনুসরণ করা হয় বলে একে সরলরৈখিক সংগঠনের সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। এটি সবচেয়ে পুরনো ধরনের সহজ প্রকৃতির সংগঠন কাঠামো । জটিলতামুক্ত ও সীমিত আয়তন বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে এরূপ সংগঠন কাঠামো অধিক ব্যবহৃত হয়। নিম্নে এরূপ সংগঠন কাঠামো রেখাচিত্রে প্রদর্শিত হলো:
উল্লেখ্য উপব্যবস্থাপক, সহব্যবস্থাপক ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গকে সাধারণভাবে পদস্থ কর্মী বিবেচনা করা হলেও তা সবসময় নাও হতে পারে । কর্তৃত্ব রেখা কিভাবে ব্যক্তিবর্গকে সমন্বিত করেছে তাই এক্ষেত্রে বিবেচ্য ।
বৃহদায়তন ও জটিল ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের জন্য সরলরৈখিক সংগঠন খুব উপযুক্ত নয় । তথাপি প্রাচীনতম সংগঠন পদ্ধতি হিসেবে এরূপ সংগঠন কাঠামো এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যার ফলে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত এটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন কাঠামো হিসেবেই বিবেচিত । নিম্নে এর বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করা হলো :
১. সরল ও সহজবোধ্য সংগঠন (Simple and easily comprehend organization): সরলরৈখিক সংগঠন একটি সরল ও সহজবোধ্য সংগঠন । এরূপ কাঠামোতে প্রতিষ্ঠানের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি ও বিভাগের অবস্থান, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায় । এ ছাড়া এরূপ সংগঠনে সহযোগী বা পদস্থ কর্মী (Staff assistant) না থাকায় কার্যক্ষেত্রে কোনো জটিলতা থাকে না ।
২. কর্তৃত্বের প্রকৃতি (Nature of authority): এরূপ সংগঠনে ঊর্ধ্বতন তার অব্যবহিত অধস্তনের ওপর অধিকমাত্রায় কর্তৃত্বশালী থাকে । ক্ষেত্রবিশেষে এরূপ ঊর্ধ্বতন তার অধীনস্থ কর্মী বা নির্বাহীদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে গণ্য হয় । আর যে কারণে অধস্তনরা বিনা দ্বিধায় ঊর্ধ্বতনের নির্দেশ মান্য করে ও জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে ।
৩. কর্তৃত্বের প্রবাহ (Flow of authority): এ ধরনের সংগঠন কাঠামোতে কর্তৃত্বরেখা ওপর থেকে নিচের দিকে আড়াআড়ি বা সরলরেখার আকারে নেমে আসে । এতে কর্তৃত্বরেখার নিচের দিকে কর্মরত নির্বাহীর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা সর্বাপেক্ষা কম হয় এবং প্রতিটা উপরিস্তরে তা ক্রমানুযায়ী বাড়তে থাকে ।
৪. স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভাগ (Self-sufficient department): এরূপ সংগঠন কাঠামোতে সংগঠনের কাজকে প্রয়োজনমাফিক বিভিন্ন বিভাগে ভাগ করা হয় এবং প্রতিটা বিভাগের জন্য একজন বিভগীয় প্রধান নিয়োজিত থাকে । উক্ত প্রধান তার বিভাগের ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন । এরূপ প্রতিটা বিভাগ অন্য বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকে ।
৫. আন্তঃবিভাগীয় যোগাযোগ (Inter-departmental communication): এ ধরনের সংগঠন কাঠামোতে বিভাগগুলো একজন সাধারণ ব্যবস্থাপক বা মহাব্যবস্থাপকের অধীনে এবং উপবিভাগগুলো বিভাগীয় ব্যবস্থাপকের অধীনে কর্মরত থাকে । ফলে আন্তঃবিভাগীয় যোগাযোগ ঊর্ধ্বতনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় ।
৬. ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা (Individuality): এক্ষেত্রে প্রত্যেক বিভাগীয় নির্বাহী তার বিভাগে একক কর্তৃত্বের অধিকারী হওয়ায় বিভাগের সকল দায়িত্বও তার ওপরই বর্তে। তার অনুপস্থিতিতে তার পক্ষে দায়িত্ব পালনের মতো কোনো সহযোগী না থাকায় পুরো বিভাগের ভালো-মন্দ একক ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ।
৭. প্রয়োগ ক্ষেত্র (Field of application): সহজ ও সরল প্রকৃতির এরূপ সংগঠন জটিল ও বৃহদায়তন কার্য পরিবেশে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করা যায় না । তাই জটিলতামুক্ত ও সীমাবদ্ধ আয়তন বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে এরূপ সংগঠন অধিক উপযোগী ।
সরলরৈখিক সংগঠন সবচেয়ে সহজ ও প্রাচীন সংগঠন কাঠামো। এরূপ সংগঠন কাঠামো সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ উপযোগী এবং ছোট প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার উপযোগী হওয়ায় সমগ্র বিশ্বে এরূপ সংগঠন কাঠামোর সংখ্যায় সর্বাধিক । নিম্নে এরূপ সংগঠনের সুবিধাসমূহ তুলে ধরা হলো:
১. কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের সুস্পষ্ট বণ্টন (Explicit distribution of responsibility and authority) : এরূপ সংগঠনে কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব স্পষ্টরূপে বর্ণিত ও বণ্টিত হয়। ফলে কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব নিয়ে কর্মীদের মাঝে কোনো ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে না ।
২. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন (Prompt decision making and execution) : এক্ষেত্রে প্রত্যেক নির্বাহী তার আপন পরিসরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী । কোনো উপদেষ্টা কৰ্মী না থাকায় আপন চিন্তার আলোকে ঊর্ধ্বতন দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নিজ দায়িত্বে তা বাস্তবায়ন করতে পারে ।
৩. সর্বোচ্চ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা (Establishing maximum discipline) : সামরিক সংগঠনের ন্যায় এরূপ সংগঠনে অধিক মাত্রায় শৃঙ্খলা বিধান সম্ভব হয়। দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হওয়ায় এবং প্রত্যেকেই তার কার্যের জন্য সর্বোতভাবে তার ঊর্ধ্বতনের নিকট দায়ী হওয়ায় সকলক্ষেত্রে সহজেই শৃঙ্খলা বজায় থাকে ।
৪. নির্বাহীর দক্ষতা বৃদ্ধি (Development of efficiency of executives) : এরূপ সংগঠন কাঠামোতে একজন নির্বাহী তার পরিসরে সকল কার্যের জন্য দায়বদ্ধ থাকে বিধায় তাকে সফল কাজ তত্ত্বাবধান ও সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে হয়; যা বিভিন্ন বিষয়ে তাকে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করে ।
৫. পদোন্নতির স্পষ্ট পথনির্দেশক (Specific indicator of promotion) : এরূপ সংগঠনে ধাপে ধাপে পদোন্নতি হয় বিধায় কর্মীরা পদোন্নতির ব্যাপারে পূর্বে জ্ঞাত থাকে এবং নিজেকে সেই অনুযায়ী গঠনে সচেষ্ট হতে পারে । যেমন-একজন ফোরম্যান তার অব্যবহিত উচ্চতর পদ সুপারভাইজার পদে পদোন্নতি পাবে এটাই এরূপ সংগঠনের সাধারণ নিয়ম ।
৬. স্থায়ী ও শক্তিশালী সংগঠন (Permanent and strong organization) : এরূপ সংগঠনে কে কার ঊর্ধ্বতন এবং কে কার অধস্তন তা সহজেই বোঝা যায়। প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তৃত্ব সংগঠন কাঠামোতে সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট থাকে । যোগাযোগ ব্যবস্থাও থাকে প্রত্যক্ষ ও সহজ। দ্বৈত অধীনতা ও সাংগঠনিক জটিলতা না থাকায় এর কাঠামো যথেষ্ট মজবুত ও শক্তিশালী হয় ।
সরলরৈখিক সংগঠন সহজ ও সরল প্রকৃতির সংগঠন হওয়ায় সাধারণ মানের প্রাতিষ্ঠানে এরূপ সংগঠন ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও প্রতিষ্ঠানের কাজ যতই বিস্তৃত হতে থাকে ততই এ সংগঠনের সমস্যাগুলো সামনে, এসে ধরা দেয় । নিম্নে এর অসুবিধাসমূহ তুলে ধরা হলো :
১. বিশেষায়ণের অভাব (Lack of specialisation) : এরূপ সংগঠন কাঠামোতে একজন নির্বাহীকে তার গণ্ডিতে সকল ধরনের কার্য সম্পাদন করতে হয় । যা সকল অবস্থায় দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা একজন নির্বাহীর পক্ষে সম্ভব হয় না । ফলে কোনো কার্যে বিশেষজ্ঞতা বা বিশেষায়ণের রীতিও কার্যকর করা যায় না।
২. স্বৈরতন্ত্রের প্রতি ঝোঁক (Tendency towards autocracy) : এক্ষেত্রে প্রত্যেক নির্বাহী নিজস্ব গণ্ডিতে সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী ও অধস্তনদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বিবেচিত হয়। যে কারণে স্বৈরতন্ত্রের প্রতি একটি স্বাভাবিক ঝোঁক প্রবণতা এরূপ সংগঠন কাঠামোতে লক্ষ করা যায় । ফলে একদল মোসাহেব বা তোষামোদকারীর সৃষ্টি হওয়া এক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক ।
৩. নির্বাহীদের কার্যভার বৃদ্ধি (Increase in workload of executives) : এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত স্বল্পসংখ্যক নির্বাহীকে তার গণ্ডিতে কোনো সহযোগীর সহযোগিতা ছাড়াই সকল কাজ সম্পাদন ও তার জন্য ঊর্ধ্বতনের নিকট দায়ী থাকতে হয়। ফলে নির্বাহীগণ সব সময়ই অতিরিক্ত কাজের চাপের মধ্যে থাকে এবং যা ফলপ্রদ কাজে বাধার সৃষ্টি করে ।
৪. নির্বাহীর অনুপস্থিতিতে ক্ষতি (Loss due to the absence of executive) : এরূপ সংগঠন কাঠামোতে বিভাগীয় নির্বাহীকে সহযোগিতা করার বা তার অনুপস্থিতিতে কার্য সম্পাদনের মতো কোনো উপদেষ্টা কৰ্মী না থাকায় কোনো কারণে তার অনুপস্থিতি ঐ বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানের কাজকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ।
৫. সমন্বয়ে সমস্যা (Problems in co-ordination) : প্রত্যেকটি বিভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকে বিধায় এরূপ সংগঠনে একমাত্র সাধারণ বা মহাব্যবস্থাপকের মাধ্যমে কার্যে সমন্বয় বিধান করতে হয়। যা অনেক ক্ষেত্রে সময়সাপেক্ষ ও জটিল হয়ে দাঁড়ায় । এ ছাড়াও সকল বিভাগ স্বাধীন হওয়ায় পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমঝোতা সৃষ্টি হয় না ।
৬. জটিল ও বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের অনুপযোগী (Unsuitable in case of complex and large scale enterprise): বর্তমান বৃহদায়তন উৎপাদনের যুগে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বড় ধরনের প্রতিষ্ঠান গঠন ও পরিচালনার কোনো বিকল্প নেই । অথচ সরলরৈখিক সংগঠনের মাধ্যমে কখনই জটিল ও বড় ধরনের সংগঠন পরিচালনা করা সম্ভব নয় ।
জনাব তালুকদার পারিবারিক সদস্যদের নিয়ে একটা কোম্পানি গঠনপূর্বক নিজেই এম.ডির দায়িত্ব নিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন । তার অধীনে উৎপাদন ব্যবস্থাপক ও বিক্রয় ব্যবস্থাপক স্ব-স্ব বিভাগের সর্বময় কর্তা হিসেবে বিভাগ চালিয়েছেন । কিন্তু প্রতিষ্ঠান বড় হওয়ায় এখন আরও কিছু বিভাগ খুলেছেন । উৎপাদন ব্যবস্থাপক ও বিক্রয় ব্যবস্থাপকদ্বয়ের একার পক্ষে বিভাগের সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন কষ্টসাধ্য মনে করে প্রত্যেকের অধীনে একজন করে সহকারী ব্যবস্থাপক নিয়োগ করেছেন । এতে উৎপাদন ব্যবস্থাপক ও বিক্রয় ব্যবস্থাপকের কাজের ভার কিছুটা কম হওয়ায় তারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন । এক্ষেত্রে জনাব তালুকদারের প্রথম গড়া সংগঠন কাঠামো ছিল সরলরৈখিক সংগঠন কিন্তু পরে সহকারী নিয়োগ দেয়ায় সংগঠন কাঠামোর প্রকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে এবং তা সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠনে রূপায়িত হয়েছে ।
যে সংগঠন কাঠামোতে কর্তৃত্ব রেখা ওপর থেকে নিচের দিকে সরলরেখার আকারে নেমে আসে এবং সরলরৈখিক নির্বাহীকে সহযোগিতা করার জন্য সহযোগী বা পদস্থ কর্মী নিয়োগ করা হয় তাকে সরলরৈখিক ও পদস্থকর্মী সংগঠন বলে । উৎপাদন ব্যবস্থাপককে সহযোগিতা করার জন্য সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপক নিয়োগ বা এরূপ পদ সৃষ্টি এ ধরনের সংগঠনের উদাহরণ । কলেজগুলোতে প্রিন্সিপ্যালকে সহযোগিতা করার জন্য ভাইস প্রিন্সিপ্যাল নিয়োগ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে গণ্য । মূলত সরলরৈখিক সংগঠনের মধ্যদিয়ে সংগঠন কাঠামোর অগ্রযাত্রা শুরু । পরবর্তীতে কাজের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় দেখা যায় যে, একজন উৎপাদন ব্যবস্থাপক বা বিক্রয় ব্যবস্থাপকের পক্ষে বিভাগীয় সকল কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন সম্ভব হচ্ছে না । আবার একই সাথে দু'জন উৎপাদন ব্যবস্থাপকও নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয় । তাই কর্মভারগ্রস্ত এরূপ ব্যবস্থাপকদের সহযোগিতার জন্য সহযোগী, সহকারী বা পদস্থকর্মী নিয়োগ দান শুরু হয় । এতে যে নতুন সংগঠন কাঠামো রূপলাভ করে তাই সরলরৈখিক ও পদন্তকর্মী সংগঠন নামে অভিহিত। তুলনামূলকভাবে বড় ও বিস্তৃত কার্যক্ষেত্রে এরূপ সংগঠন কাঠামো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় । পদস্থ কর্মী (Staff) এর সহযোগিতার ওপর এক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেয়ার কারণে একে অনেকেই পদস্থকর্মী সংগঠন (Staff organization) নামে অভিহিত করেন। নিম্নে এরূপ সংগঠন কাঠামো রেখাচিত্রে প্রদর্শিত হলো :
সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠনের বৈশিষ্ট্য :
১. এরূপ সংগঠনে দু'ধরনের কর্মী থাকে; একদল সরলরৈখিক কর্মী বা নির্বাহী ও অন্যদল উপদেষ্টা কর্মী;
২. দু'ধরনের কর্মী থাকায় এক্ষেত্রে দু'ধরনের কর্তৃত্ব বিরাজ করে; যথা- সরলরৈখিক কর্তৃত্ব ও সহযোগী কর্তত্ব;
৩. এক্ষেত্রে সংগঠনের কর্তৃত্বরেখা ব্যবস্থাপনার শীর্ষস্তর হতে ক্রমান্বয়ে নিম্নস্তরে নেমে আসে;
৪. এক্ষেত্রে সরলরৈখিক কর্মকর্তার পাশে উপদেষ্টা কর্মীগণ প্রয়োজনীয় অবস্থান গ্রহণ করে;
৫. দু'ধরনের কর্মী থাকলেও সরলরৈখিক কর্মকর্তাগণই এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে এবং
৬. পদস্থ বা সহযোগী কর্মীদের কাজ হলো সরলরৈখিক কর্মকর্তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উপদেশ প্রদান এবং কার্যক্ষেত্রে সহযোগিতা করা ।
উল্লেখ্য উপরের চিত্রে যদি মহা-ব্যবস্থাপকের অধীনে সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক এবং তার অধীনে বিভাগীয় ব্যবস্থাপকগণ থাকতেন তবে সহকারী মহা-ব্যবস্থাপক সরলরৈখিক নির্বাহী গণ্য হতেন ।
সরলরৈখিক কর্মকর্তা ও পদস্থ কর্মী সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন কাঠামোকেই সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠন বলে । সরলরৈখিক সংগঠনের ত্রুটিসমূহ দূরপূর্বক অতিরিক্ত সুবিধা অর্জনের জন্যই মূলত এরূপ সংগঠনের উদ্ভব ঘটে । আমাদের দেশে বৃহদায়তন সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান; যেমন- ব্যাংক, বিমা, সরকারি প্রশাসন ইত্যাদি সর্বত্রই আমরা এ ধরনের সংগঠন কাঠামোর ব্যবহার দেখাতে পায় । যে সকল সুবিধার কারণে সর্বত্র এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. নির্বাহীর কর্মভার লাঘব (Relieving burden of executives) : এরূপ সংগঠনে সরলরৈখিক নির্বাহীকে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উপদেষ্টা বা সহযোগী কর্মী নিয়োগ করায় নির্বাহীর কর্মভার অনেকাংশে লাঘব হয় । ফলে সে দক্ষতার সাথে কার্য সম্পাদন করতে পারে । এতে নির্বাহীর কর্মদক্ষতার উন্নয়ন ঘটে ।
২. স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ হ্রাস (Reducing the chance of whims) : এ ধরনের সংগঠনে স্বাভাবিকভাবেই একজন নির্বাহী তার দায়-দায়িত্বের অংশ বিশেষ সহযোগী বা উপদেষ্টা কর্মীর ওপর অর্পণ করে । এ ছাড়াও বিশেষজ্ঞ কর্মীর উপস্থিতি থাকায় প্রয়োজনীয় বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ এক্ষেত্রে সরলরৈখিক নির্বাহীর নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় । ফলে তার স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায় ।
৩. সমস্যার দ্রুত সমাধান (Prompt solution of problems) : সরলরৈখিক সংগঠনে নির্বাহী নানান কাজে ব্যস্ত থাকায় অনেক সময় তার পক্ষে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে যথাযথ ভূমিকা পালন সম্ভব হয় না । কিন্তু এক্ষেত্রে উপদেষ্টা কর্মীর উপস্থিতি থাকায় তারা সমস্যা সমাধানে নির্বাহীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে। ফলে সমস্যার দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হয়।
৪. শ্রম বিভাগের সুফল অর্জন (Achieving the merits of division of labour) : এ ধরনের সংগঠনে একজন নির্বাহী তার কাজের অংশবিশেষ সহযোগীর ওপর অর্পণ করতে পারে । ইচ্ছে করলে একজন নির্বাহী তার কাজ সহযোগীর সাথে ভাগ করে যে যে কাজের যোগ্য সে সেই কাজ সম্পাদন করে। এতে প্রত্যেকের পক্ষে একই ধরনের কাজ করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন সম্ভব হয় । ফলে কার্যক্ষেত্রে দক্ষতার উন্নয়ন ঘটে ।
৫. নমনীয়তা অর্জন (Achieving flexibility) : সরলরৈখিক সংগঠনে নির্বাহীগণ অনেক সময় কার্যক্ষেত্রে এত ব্যস্ত থাকে যাতে প্রতিষ্ঠানের জন্য নতুন চিন্তা-ভাবনা ও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না । কিন্তু পদস্থ কর্মী কর্মরত থাকায় নির্বাহী যেমনি নতুন চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ পায় তেমনি প্রয়োজনে একাধিক সহযোগী নিয়োগ করে কর্মক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করতে পারে ।
৬. সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণে সুবিধা (Advantages of co-ordination & control) : এরূপ সংগঠনে পদস্থ কর্মীগণ অন্য বিভাগের খোঁজখবর গ্রহণ, তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রদান ইত্যাদি কাজ করতে পারায় অন্য বিভাগের সাথে প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন সহজ হয়। এ ছাড়া অধস্তনের কাজের খোঁজখবর গ্রহণ, কার্যফল মূল্যায়ন ও প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপও অনেক সহজ হয়ে থাকে ।
বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানসমূহে সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা গেলেও এরূপ সংগঠন ত্রুটিমুক্ত এ কথা বলা যায় না। প্রকৃতিগত কারণেই এক্ষেত্রে যেমনি কিছু সমস্যা লক্ষণীয় তেমনি দু- ধরনের নির্বাহীদের কর্তৃত্ব প্রয়োগে ব্যক্তিগত সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা অনেক সময়ই এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেয় । নিম্নে এরূপ সংগঠনের অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. ব্যয় বৃদ্ধি-(Increase in expenditure) : এ ধরনের সংগঠনে সরলরৈখিক নির্বাহীকে সহযোগিতা করার জন্য প্রয়োজনে এক বা একাধিক পদস্থ কর্মী নিয়োগ করা হয়। অনেক সময় পদস্থ কর্মী নিয়োগকে নির্বাহী নিজের জন্য অধিক মর্যাদাকর গণ্য করে । ফলে প্রয়োজনের বাইরেও পদস্থ কর্মী নিয়োগের প্রবণতা লক্ষ করা যায় । এতে প্রতিষ্ঠানে ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ।
২. সহযোগীদের কর্তৃত্ব ও কার্য বিষয়ে অস্পষ্টতা (Lack of clarity in delegation of authority and responsibility) : এক্ষেত্রে সরলরৈখিক নির্বাহীদের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব সুস্পষ্টভাবে সংগঠন কাঠামোতে বর্ণিত হলেও পদস্থ কর্মীদের ক্ষেত্রে তা থাকে না। পদস্থ কর্মীর কাজ হয় নির্বাহীর ইচ্ছা মোতাবেক প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করা । ফলে তার কাজে অস্পষ্টতা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় এবং সমস্যা দেখা দেয়।
৩. বিশেষজ্ঞ কর্মীদের উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা (Chance of being neglected of the expertise) : এরূপ সংগঠনে সরলরৈখিক নির্বাহীরা সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী থাকে। পদস্থ বা বিশেষজ্ঞ কর্মীদের কার্যত কোনো কর্তৃত্ব এতে থাকে না। সরলরৈখিক নির্বাহীদের দেয়া কাজ বা দায়-দায়িত্ব তারা পালন করে এবং উক্ত নির্বাহীর নিকটই কাজের জন্য জবাবদিহি করে। বিশেষজ্ঞ কর্মী কোনো উপদেশ বা পরামর্শ দিলেও তা মানতে নির্বাহী বাধ্য থাকে না । ফলে বিশেষজ্ঞ কর্মী বা উপদেষ্টারা অনেক সময়ই উপেক্ষিত হয় ।
৪. কর্মকর্তাদের মধ্যে মনোমালিন্য সৃষ্টি (Generating conflict among the executives) : এরূপ সংগঠনে অনেক সময় স্বেচ্ছাচারী নির্বাহী ও উপেক্ষিত বিশেষজ্ঞ কর্মীর মধ্যে মনোমালিন্য লক্ষ করা যায় । যা সহযোগিতার পরিবর্তে অসহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে ও জটিল পরিবেশের জন্ম দেয়। আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেই গ্রুপিং-লবিং এর বড় কারণ হলো উভয় ধরনের কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা মনোমালিন্য ।
৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব (Delay in decision making) : এরূপ সংগঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় নির্বাহীগণ অনেক সময়ই উপদেষ্টা কর্মীদের সাথে শলা-পরামর্শে অধিক সময় ব্যয় করে বা তাদের ওপর নির্ভর করে যা ক্ষেত্রবিশেষে ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অহেতুক বিলম্বের কারণ হয় ।
৬. বিশেষজ্ঞ কর্মীদের যোগ্যতার বিকাশে বাধা (Barrier to the flourish of the quality of expertise) : এরূপ সংগঠনে বিশেষজ্ঞ কর্মীগণ দায়িত্ব-কর্তৃত্ব ছাড়াই নির্দিষ্ট গণ্ডিতে সহায়তাকারী হিসেবে কার্যে নিয়োজিত থাকায় অধিক দায়িত্ব, কর্তৃত্ব ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে তারা নিরুৎসাহবোধ করে । ফলে তাদের যোগ্যতার বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
মি. কবীরের শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজের বিস্তৃতি বাড়ায় উৎপাদন ব্যবস্থাপককে সহযোগিতা করার জন্য একজন যন্ত্র প্রকৌশলী ও একজন কোয়ালিটি নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞকে সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে । বিভাগীয় কর্তৃত্ব এককভাবে উৎপাদন ব্যবস্থাপকের থাকায় তার দ্বারা এ দু'জন সহকারী উপেক্ষিত হন।
ফলে তাদের যোগ্যতা কোনো কাজে আসছে না । এখন উৎপাদন সংক্রান্ত কাজ সঠিকভাবে তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব একজন সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (উৎপাদন) বা সহসভাপতি (উৎপাদন)এর অধীনে রেখে উৎপাদন বিভাগের কাজকে যন্ত্র প্রকৌশল, কাঁচামাল ব্যবস্থাপনা, মান নিয়ন্ত্রণ, মেরামত ও সংরক্ষণ এ চারটা বিভাগে ভাগ করে পদস্থ বা বিশেষজ্ঞ কর্মীদের সীমিত সরলরৈখিক কর্তৃত্ব সহযোগে বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত করা হয়েছে। এতে কারও উপেক্ষিত হওয়ার আশঙ্কা আর নেই । বরং প্রত্যেকেই নিজস্ব পরিসরে যোগ্যতা প্রদর্শন করে দক্ষতার প্রমাণ দিতে পারছে । এক্ষেত্রে মি. কবীরের উৎপাদন বিভাগের জন্য গড়া নতুন সংগঠন কাঠামো হলো কার্যভিত্তিক সংগঠন ।
যে সংগঠন কাঠামোতে কাজকে প্রকৃতি অনুযায়ী ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে তার দায়িত্ব বিশেষজ্ঞ কর্মীদের ওপর সীমিত সরলরৈখিক কর্তৃত্ব সহযোগে অর্পণ করা হয় তাকে কার্যভিত্তিক সংগঠন বলে । সরলরৈখিক ও পদস্থ কর্মী সংগঠনে লক্ষণীয় যে, সরলরৈখিক নির্বাহীকে সহযোগিতা করার জন্য এক বা একাধিক পদস্থ, সহযোগী বা বিশেষজ্ঞ কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়। উদ্দেশ্য থাকে উভয় ধরনের কর্মী বা নির্বাহীগণ মিলে-মিশে দায়িত্ব পালন করবেন । কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উভয় ধরনের নির্বাহীর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রতিষ্ঠানের ক্ষতির কারণ হয় । সকল কর্তৃত্ব সরলরৈখিক নির্বাহীর থাকায় অনেক সময় যোগ্য বিশেষজ্ঞ সহকারী তার দ্বারা উপেক্ষিত হয়। এতে বিশেষজ্ঞ কর্মী হতাশ থাকেন এবং তার নিয়োগের উদ্দেশ্যই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই কার্যভিত্তিক সংগঠন কাঠামোর উদ্ভব ঘটেছে । এফ. ডব্লিউ. টেইলর এরূপ সংগঠন কাঠামোর উদ্ভাবক ।
বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ও বিপণনের মত বিভাগগুলোর জন্য এ ধরনের সংগঠন কাঠামো খুবই কার্যকর । নিম্নে এ ধরনের সংগঠন কাঠামো রেখাচিত্রে প্রদর্শিত হলো:
কার্যভিত্তিক সংগঠনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো :
১. কাজের ধরন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের সকল কাজকে এক্ষেত্রে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা হয়;
২. এর প্রতিটি বিভাগ একযোগে সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগকে সেবা প্রদান করে;
৩. এর প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্ব একজন বিশেষজ্ঞের ওপর ন্যস্ত করা হয়;
৪. যিনি উচ্চ পর্যায়ে কর্মরত সরলরৈখিক নির্বাহীর অনুমোদনক্রমে সীমিত কর্তৃত্ব ভোগ করেন এবং
৫. বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বিভাগে এ ধরনের সংগঠন কাঠামো অধিক ব্যবহৃত হয় ।
সুদীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষানবিস কর্মী হতে শুরু করে বড় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে F. W. Taylor তার অভিজ্ঞতার ফসল হিসেবে যে নতুন ধরনের সংগঠন কাঠামোর রূপরেখা প্রদান করেন তাই কার্যভিত্তিক সংগঠন (Functional Foremanship) নামে অভিহিত । এরূপ সংগঠনের যে সকল সুবিধা লক্ষণীয় তা নিম্নরূপ :
১. কার্যক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের জ্ঞান প্রয়োগ (Application of specialised knowledge) : সংগঠনে বিশেষজ্ঞদেরকে শুধুমাত্র উপদেষ্টা হিসেবে বিবেচনা না করে তাদের ওপর সরাসরি নির্বাহী ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। এতে বিশেষজ্ঞগণ স্বাধীনভাবে তাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারে। ফলে প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয় ।
২. স্বেচ্ছাচারিতা হ্রাস (Reduction of autocracy) :কার্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন এরূপ সংগঠনে নিশ্চিত করা যায় । ঊর্ধ্বতন নির্বাহীগণ বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে তারা স্বেচ্ছাচারী হতে পারে না। অন্যদিকে কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করায় বিশেষজ্ঞ কর্মীগণও কর্মক্ষেত্রে স্বৈরাচারী হওয়ার সুযোগ পায় না ।
৩. বিশেষায়ণ ও কর্মী উন্নয়ন (Specialization and employee development ) : এক্ষেত্রে কাজকে বিশেষজ্ঞতার ভিত্তিতে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করায় কার্যক্ষেত্রে যেমনি বিশেষায়ণের সুযোগ নিশ্চিত হয় তেমনি বিশেষজ্ঞের অধীনে কাজ করতে গিয়ে অধস্তনরা সরাসরি তার নিকট হতে অনেক কিছুই শিখতে পারে । ফলে অধস্তনদের মান উন্নীত হয় ।
৬. নমনীয়তা বৃদ্ধি (Increase in flexibility) : বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে এরূপ প্রতিষ্ঠানের সকল কাজ নির্বাহ হওয়ার কারণে তারা স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের সাথে সহজেই সঙ্গতি বিধান করতে পারে । ফলে নমনীয়তা অর্জন সহজ হয়। এ ছাড়া এক্ষেত্রে কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করায় প্রয়োজনে কোনো নতুন বিভাগ প্রতিষ্ঠা বা কোনো বিভাগ বন্ধ করে দেয়া যায় ।
৫. নিয়ন্ত্রণে সহায়তা (Aid to controlling) : এরূপ সংগঠনে কাজগুলো ছোট ছোট বিভাগে ভাগ করায় একজন বিশেষজ্ঞ কর্মীর অধীন কাজের আওতা ছোট হয় । ফলে কার্যফল মূল্যায়ন সহজ হয় । প্রতিটি বিভাগের জন্য এমনকি ব্যক্তির জন্য কাজের পূর্ব নির্ধারিত মান নির্দিষ্ট থাকায় জবাবদিহিতাও সহজ হয়। যে কারণে প্রতিষ্ঠানে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায় ।
কার্যভিত্তিক সংগঠনের বেশ কিছু সুবিধা থাকলেও এরূপ সংগঠনের অসুবিধার পরিমাণও কম নয় । নিম্নে এর অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. কর্মীদের কর্মভার বৃদ্ধি (Increase in workload of employees) : এরূপ সংগঠনে একটি বিভাগ প্রয়োজনে একাধিক বিভাগকে সেবা প্রদান করতে বাধ্য থাকে । যে কারণে কোনো একটি বিভাগীয় কর্মীদের ওপর একই সময়ে অন্য একাধিক বিভাগ হতে সেবা সুবিধা প্রদানের নির্দেশ আসতে পারে । আর এরূপ অবস্থায় উক্ত বিভাগের কর্মীদের কর্মভার বৃদ্ধি পায় এবং তারা সঠিকভাবে কার্য সম্পাদনে ব্যর্থ হয় ।
২. সরলরৈখিক কর্মকর্তাদের প্রভাব হ্রাস (Reduction in influnce of line-authority) : এ ধরনের সংগঠনে কাজের মূল দায়িত্ব থাকে বিশেষজ্ঞ কর্মীদের ওপর। যারা স্ব-স্ব বিভাগে নির্বাহীর দায়িত্ব পালন করে । সরলরৈখিক নির্বাহী বলতে যা বুঝায় তা থাকে মূলত সংগঠন কাঠামোর একেবারে ওপর পর্যায়ে। বিশেষজ্ঞ কর্মীগণ মূল চালকের ভূমিকায় অবস্থান করায় সংখ্যালঘু সরলরৈখিক নির্বাহীদের কর্তৃত্ব এক্ষেত্রে হ্রাস পায়। যা প্রকারান্তরে সমস্যার সৃষ্টি করে ।
৩. দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ (Opportunity to avoid responsibility) : এক্ষেত্রে একটি বিভাগ বা বিভাগীয় কর্মীগণ একই সাথে একাধিক বিভাগের আদেশ-নির্দেশ পালন করায় কার্যক্ষেত্রে দ্বৈত অধীনতার সৃষ্টি হয় । ফলে কোনো কর্মী বা বিভাগ ইচ্ছা করলে অন্যের দোহাই দিয়ে কাজে ফাঁকি দিতে পারে । দ্বৈত অধীনতার কারণে এক্ষেত্রে অধস্তনদের সঠিকভাবে জবাবদিহিও করা যায় না ।
৪. শৃঙ্খলার অভাব (Lack of discipline) : এ ধরনের সংগঠনে কাজকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করায় এমনিতেই যথাযথ তত্ত্বাবধান, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয় । তদুপরি কোনো অধস্তন কর্মী বা বিভাগ একাধিক ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞের অধীনে কাজ করায় কার্যক্ষেত্রে মারাত্মক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় । এরূপ সংগঠন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ না করার পিছনে এটাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়ে থাকে ।
৫. প্রয়োগ ক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা (Limitation of applicability) : কার্যভিত্তিক সংগঠন কাঠামো এমনিতেই যথেষ্ট জটিল । নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বৃহদায়তন উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বিভাগেই এর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার সম্ভব । ক্রয়, বিক্রয়, অর্থ, শ্রমিক-কর্মী ইত্যাদি বিভাগে কার্যভিত্তিক সংগঠন কাঠামোর পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার কার্যত সম্ভব নয় ।
কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি । প্রিন্সিপ্যালের একার পক্ষে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বিধায় তিনি কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষককে দিয়ে ভর্তি কমিটি করে দিয়েছেন। যাদের কাজ হবে ক্লাস নেয়ার পাশাপাশি সম্মিলিতভাবে ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রশাসনকে সহায়তা করা । মি. ইসলামের কারখানায় দু'টি বিভাগের শ্রমিকেরা মারামারি করেছে। মি. ইসলাম দুই বিভাগের প্রধান ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহযোগে পাঁচ সদস্যের কমিটি করে দিয়েছেন । এক সপ্তাহের মধ্যে গণ্ডগোলের কারণ ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে হবে । এই ব্যক্তিবর্গও তাদের স্ব-স্ব কাজের বাইরে একত্রে বসে সম্মিলিতভাবে এ দায়িত্ব পালন করবেন । এভাবেই দেখা যায়, শিল্প প্রতিষ্ঠানে সমন্বয় কমিটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্রয় কমিটি, ভর্তি কমিটি, পরীক্ষা কমিটি, মসজিদে মসজিদ কমিটি, হাটে হাট কমিটি, মার্কেটে মার্কেট কমিটি, খেলার জন্য টুর্নামেন্ট কমিটি ইত্যাদি নানান কমিটি গঠন করা হয় । প্রশাসন পরিচালনার সর্বস্তরে নানান প্রয়োজনেই কমিটি গঠন করতে দেখা যায় । এভাবেই কমিটি বা কমিটি সংগঠন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বর্তমানে একটা সহযোগী অপরিহার্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে ।
প্রতিষ্ঠান বা ঊর্ধ্বতনের পক্ষ থেকে অথবা আইন, বিধি বা গঠনতন্ত্রবলে বিশেষ কোনো কার্য সম্পাদনের ভার একাধিক ব্যক্তির ওপর অর্পিত হলে ঐ ব্যক্তিবর্গের সমষ্টিকে কমিটি বলে । এরূপ ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে সম্পর্কের কাঠামোর সৃষ্টি হয় তাকে কমিটি সংগঠন বলা হয়ে থাকে। সাধারণভাবে কমিটিতে একজন চেয়ারম্যান বা আহবায়ক থাকেন । যিনি কমিটির সভায় সভাপতিত্ব করেন ও দায়িত্ব পালনে সমষ্টিগত প্রচেষ্টাকে জোরদার করেন । প্রয়োজনে কমিটির একজন সদস্য সচিবও করা হতে পারে। যিনি সভাপতির নির্দেশমত প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেন। তবে কমিটির সকল সদস্য কমিটির কাজে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমঅধিকার ভোগ করেন । বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অবাঞ্চিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণ্ডগোল ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে । চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে । ভিসি মহোদয়, বিষয়টি দেখে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য প্রক্টরকে আহবায়ক করে বিভিন্ন দায়িত্বশীল শিক্ষক সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের কমিটি করে দিয়েছেন । এটি ঊর্ধ্বতনের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটি । বেসরকারি স্কুল ও কলেজ পরিচালনার জন্য আইনে পরিচালনা কমিটি বা গভর্নিং বডি নিয়োগের বিধান রয়েছে । এর সদস্যগণ যথানিয়মে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্বাচিত বা মনোনীত হন । এটি নিয়ম বা বিধি বলে গঠিত কমিটির উদাহরণ । দু'টি ক্ষেত্রেই ব্যক্তিবর্গ কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই সম্মিলিতভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেন । কমিটি স্থায়ী বা অস্থায়ী যে কোনো ধরনের হতে পারে । শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গভর্নিং বডি, শিল্প প্রতিষ্ঠানে সমন্বয় কমিটি, মার্কেট কমিটি, মসজিদ বা মন্দির পরিচালনা কমিটি ইত্যাদি স্থায়ী প্রকৃতির । অন্যদিকে তদন্ত কমিটি, ভর্তি কমিটি, সিলেবাস প্রণয়ন কমিটি ইত্যাদি অস্থায়ী কমিটির উদাহরণ । কমিটিকে বোর্ড, কমিশন, কাউন্সিল, টাস্কফোর্স ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয় ।
কমিটি বর্তমানকালে একটি বহুল ব্যবহৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানে এমন কিছু কাজ থাকে যা সরলরৈখিক নির্বাহী বা উপদেষ্টা কৰ্মী নিয়োগ বা কোনো বিশেষ বিভাগ খুলে সম্পাদন করা যায় না । অথচ উক্ত কাজ সম্পাদন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয় । তাই উক্ত বিশেষ কাজ সম্পাদনের জন্য বিশেষ সাংগঠনিক ব্যবস্থা হিসেবেই কমিটির ব্যবহার করা হয়ে থাকে । নিম্নে কমিটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো :
১. একাধিক ব্যক্তির সম্মিলন (Association of a group of people) : কমিটি হলো কতিপয় ব্যক্তির সমষ্টি । এখানে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একাধিক ব্যক্তির সম্মিলন ঘটে। এর সদস্যদের দায়িত্বও থাকে যৌথ । এক সদস্যের কমিটি গঠনের কথা কখনও বলা হলেও কার্যত তাকে কমিটি বলার কোনো সুযোগ নেই । কমিটিকে যদি একটি সংগঠন ধরা হয় তবে একক সদস্যের সমন্বয়ে কখনই কমিটি সংগঠন গড়ে উঠে না ।
২. নির্বাচিত বা মনোনীত সদস্য (Elected or nominated member) : কমিটির সদস্যগণ সাংগঠনিক নিয়মে নির্বাচিত বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃক মনোনীত হয়ে থাকে । কোনো কোম্পানিতে পরিচালনা বোর্ডের সদস্যগণ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত নিয়মে নির্বাচিত হন। কলেজ গভর্নিং বডিও নির্দিষ্ট নিয়মে নির্বাচিত হয়ে থাকে । আবার কোনো বিষয়ে তদন্ত কমিটি, সুপারিশ কমিটি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কমিটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যগণ ঊর্ধ্বতন কর্তৃক মনোনীত হন ।
৩. স্থায়ী বা অস্থায়ী প্রকৃতি (Permanent or temporary in nature) : কমিটি স্থায়ী বা অস্থায়ী বিভিন্ন ধরনের হতে পারে । কোনো প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ কমিটি, অর্থ কমিটি, সমন্বয় কমিটি ইত্যাদি স্থায়ী প্রকৃতির কমিটি । অন্যদিকে তদন্ত কমিটি, সাক্ষাৎকার বোর্ড, প্রতিবেদন প্রণয়ন কমিটি ইত্যাদি অস্থায়ী প্রকৃতির কমিটি ।
৪. খণ্ডকালীন বা অস্থায়ী কর্ম (Part-time or temporary function) : কমিটির সদস্যপদ কোনো স্থায়ী বা সার্বক্ষণিক কর্ম নয় । কমিটি সদস্যদের সাধারণত একটি পৃথক নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্র বা পরিমণ্ডল থাকে । কমিটির সদস্য নির্বাচিত বা মনোনীত হওয়ার কারণে এটা তাদের একটা অতিরিক্ত কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয় । এজন্য তারা কোনো বেতন পান না । মিটিং-এ উপস্থিত হওয়ার জন্য তাদেরকে সাধারণত সম্মানী বা ভাতা দেওয়া হয়ে থাকে ।
৫. বহুমুখী উদ্দেশ্যে ব্যবহার (Use for multiple purposes) : বর্তমানকালে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ও বহুমুখী প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করা হয় । প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে সরলরৈখিক কর্তৃত্ব সহযোগে যেমনি কমিটি গঠন করা হয় তেমনি অনেক সময় ঊর্ধ্বতনকে সহযোগিতা করার জন্যও কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে । পরামর্শ প্রদান, বিশেষ প্রশাসনিক কাজ সম্পাদন, বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, কোনো জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা ইত্যাদি নানান প্রয়োজনেই প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করা হয়ে থাকে ।
৬. সদস্যদের সমমর্যাদা (Equal status of members) : কমিটির সদস্যরা প্রত্যেকই সমান মর্যাদা ও কর্তৃত্ব ভোগ করে । কমিটির কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কাউকে কমিটির আহ্বায়ক, চেয়ারম্যান বা সদস্য সচিব মনোনীত করা হলেও কমিটির সভায় প্রত্যেক সদস্যই সমান মর্যাদা ও কর্তৃত্বের অধিকারী হয় । এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নীতিমালার অনুসরণ করা হয়ে থাকে । সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত অনুযায়ী এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ।
৭. সহযোগী ব্যবস্থা (Subsidiary arrangement) : প্রাতিষ্ঠানিক কার্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান সংগঠন কাঠামোর বাইরে কমিটি বা কমিটি সংগঠন একটি বিশেষ সহযোগী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে । কমিটি গঠন করে প্রতিষ্ঠানের সকল কাজ পরিচালনা সম্ভব নয় । অথচ এমন কিছু কাজ রয়েছে যা সরলরৈখিক নির্বাহী বা পদস্থ কর্মী দিয়েও সম্পাদন সম্ভব হয় না। সেখানে সংগঠনের অভ্যন্তরে কমিটি একটি সহযোগী ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে ।
যে কোন ধরনের বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানে কমিটি একটি অতি পরিচিতি নাম এবং বহুল ব্যবহৃত সাংগঠনিক বিষয় । অনেকেই নানানভাবে কমিটিকে সমালোচনা করলেও প্রতিষ্ঠানসমূহে এর ব্যাপক ব্যবহার এর উপযোগিতাই প্রমাণ করে । যে সকল সুবিধার কারণে কমিটির ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয় তা নিম্নরূপ :
১. দলগত বিচার-বিবেচনার সুযোগ (Opportunity to group-decision) : কথায় আছে 'Two heads are better than one' বাস্তবেও কোনো জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সম্মিলিত চিন্তা বা বিচার-বিবেচনা অধিক ফলপ্রসূ হতে দেখা যায়। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে অনেক জ্ঞানী-গুণী ও প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকদের অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ থাকে । ফলে দলগত বিচার-বিবেচনার সুযোগে প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয় ।
৪. যোগাযোগের সুবিধা (Advantage in communication) : কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত প্রয়োজনীয় সকল স্তরে জ্ঞাত করানোর ক্ষেত্রেও বিশেষ সুবিধা অর্জন করা যায়। বিভাগীয় প্রধানদের দ্বারা বা প্রয়োজনীয় পক্ষসমূহের সদস্যদের দ্বারা সৃষ্ট কমিটি, গৃহীত সিদ্ধান্ত নিজ দায়িত্বেই অধস্তনদের জ্ঞাত করে বিধায় এতে সময় ও খরচ উভয়ই বাঁচানো যায়।
৩. স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের প্রতিনিধিত্ব (Representation of group-interest) : একটি প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক নিয়মেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব থাকে সরলরৈখিক নির্বাহীদের ওপর । অথচ প্রতিষ্ঠানে অনেক সময় এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহের সাথে আলোচনার প্রয়োজন পড়ে । তাই সেখানে বিভিন্ন পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি গঠন সবচেয়ে কার্যকর সহায়তা প্রদান করতে পারে ।
২. সহযোগিতা বৃদ্ধি (Increase of co-operation) : কমিটি প্রতিষ্ঠানে সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে । যেহেতু কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনায় সকল সদস্যের কম-বেশি অবদান থাকে, তাই এটি বাস্তবায়নে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা লাভ করা যায় ।
৫. ব্যক্তিগত দায় এড়ানোর সুযোগ (Opportunity to avoid personal liability) : কমিটি একজন দক্ষ প্রশাসককে অনেক বিষয়ে ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ প্রদান করে । কমিটির মাধ্যমে তিনি নিজ চিন্তা কার্যে রূপায়িত করেন যা হয়তোবা নিজ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দ্বারা বাস্তবায়নে অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ।
৬. অবাঞ্ছিত সমস্যা এড়ানো (Avoidance of unwanted situation) : অনেক ক্ষেত্রে নির্বাহী এমন সমস্যার সম্মুখীন হন যেক্ষেত্রে ত্বরিত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেমনি যুক্তিযুক্ত হয় না তেমনিভাবে নির্লিপ্ততাও মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করে। এমন অবাঞ্ছিত অবস্থা এড়ানোর জন্য কমিটি গঠন অব্যর্থ মহৌষধের ভূমিকা পালন করে ।
কমিটি কতিপয় সুবিধার কারণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও এর অসুবিধার পরিমাণও কম নয় । আজকাল সাধারণভাবেই মনে করা হয়, কোনো কাজে বা সিদ্ধান্তে বিলম্ব করতে চাইলে এর সহজ উপায় হলো একটা কমিটি করে দেয়া । এ ছাড়া নানানভাবেই কমিটিকে সমালোচনা করা হয়ে থাকে । যে সকল অসুবিধার কারণে কমিটি সমালোচিত হয় তা নিম্নরূপ :
১. বিভক্ত দায়িত্ব (Divided responsibility) : দায়িত্ব এককভাবে কারও ওপর নির্দিষ্ট না করে একাধিক ব্যক্তির ওপর তা অর্পিত হলে একে বিভক্ত দায়িত্ব বলে । কমিটির ক্ষেত্রে কার্যকরণের দায়-দায়িত্ব সকল সদস্যের সমান । তাই এতে “সকলের দায়িত্ব অর্থ কারও দায়িত্ব নয়” (Everybody's responsibility is nobody's responsibility)- প্রবাদ এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। কমিটির কাজের বাইরে এর সদস্যদের দায়িত্ব নির্দিষ্ট থাকায় তারা সেই কাজের ব্যাপারে যতটুকু আন্তরিক হয় সামষ্টিক দায়িত্বের ক্ষেত্রে তা হয় না । যার কারণে লক্ষ্যার্জন ব্যাহত হয় ।
২. ধীরগতিসম্পন্ন (Slowness) : নির্বাহীগণ কাজের ফাঁকে মিটিং-এ বসাকে কষ্টকর বাড়তি কাজ মনে করে । ফলে মিটিং ডাকার পরও তা হয় না বা দেরিতে শুরু হয় । নানা কথাবার্তা, বাক-বিতণ্ডা, দ্বিমত, সভা মুলতবি ইত্যাদি কারণে কমিটির কাজ অত্যন্ত ধীরগতিতে চলে । ফলশ্রুতিতে ফলাফল শুভ হয় না ।
৩. সিদ্ধান্তহীনতার প্রতি ঝোঁক (Tendency towards indecision) : সিদ্ধান্তহীনতার প্রতি ঝোঁক প্রবণতা কমিটির কাজে আরেকটি বড় বাধা । একদিকে কমিটির মিটিং-এ বসায় এক সমস্যা অন্যদিকে মিটিং-এ “নানা মুনির নানা মত” তাই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অনেকক্ষেত্রেই জটিল হয়ে পড়ে । বিভক্ত দায়িত্বের কারণে এরূপ অবস্থা সবার জন্য তেমন মাথাব্যথার কারণ হয় না। ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব হয় ।
৪. আপসমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশঙ্কা (Danger of compromising decision) : কমিটির আলোচনায় মতামতের ভিন্নতা, সংখ্যালঘু সদস্যদের বাড়াবাড়ি এবং এ ছাড়া সিদ্ধান্তের পক্ষে সকল সদস্যের মত লাভের প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই আপসমূলক সিদ্ধান্তের জন্ম দেয় । আর এরূপ আপসমূলক সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভালো ফল দেয় না ।
৫. নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠার প্রবণতা (Tendency to establish own opinion) : কমিটির সভায় সকল সদস্যের সমান অধিকার থাকায় সদস্যদের মতামত প্রতিষ্ঠার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। সভায় প্রত্যেক সদস্যের অধিকার সমান হওয়ায় কেউ কথা বলতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া যায় না । কমিটির সভাপতির মধ্যে এরূপ প্রবণতা সুদৃঢ় হলে কমিটির কাজে আরো মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয় ।
মি. সরকার বৃহদায়তন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক । তার প্রতিষ্ঠানে A, B ও C তিন ধরনের পণ্য প্রস্তুত হয় । প্রতি বছরে মোট উৎপাদন ও বিক্রয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার সাথে মিলিয়ে মুনাফাও বাড়ছে । উৎপাদন ও বিক্রয় বিভাগের কাজে মি. সরকার খুশী । কিন্তু একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, A পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় যেভাবে বাড়ছে B ও C পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় সেভাবে বাড়ছে না । তিনি B ও C পণ্যের বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলেন, A পণ্য যথেষ্ট চলার কারণে উৎপাদন বিভাগ ও বিক্রয় বিভাগ একটা পণ্য নিয়েই বেশি ব্যতিব্যস্ত রয়েছে । তিনি ভাবলেন, যদি কোনো কারণে A পণ্যের বাজার পড়ে যায় তবে তিনি বিপদে পড়বেন। তাই B ও C পণ্যের বিক্রয় অবশ্যই বাড়াতে হবে । তিনি চিন্তা করলেন A, B ও C পণ্য তিনটাকে আলাদা আলাদা প্রজেক্ট ধরে নিয়ে যদি প্রতিটা প্রজেক্টের জন্য একজন করে ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হয় তবে প্রত্যেক প্রজেক্ট ম্যানেজার তার পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয়ের বিষয়ে দায়িত্বশীল থাকবেন। এতে প্রতিটা পণ্য সমান গুরুত্ব পাওয়ায় লক্ষে পৌঁছানো সহজ হবে । তাই তিনি সংগঠন কাঠামোতে পরিবর্তন আনলেন । উৎপাদন, বিক্রয়সহ আগে যে বিভাগগুলো ছিল তাদের ব্যবস্থাপকদের কার্যিক (Functional) ব্যবস্থাপক ঘোষণা করলেন। যাদের কাজ হবে প্রজেক্ট ম্যানেজারগণের ফরমায়েশ ও প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করা। এতে তিনি লক্ষ করছেন যে, প্রজেক্ট ব্যবস্থাপকগণের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে এবং এতে B ও C পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয় দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে । এক্ষেত্রে মি. সরকার যে নতুন সংগঠন কাঠামো গড়ে তুলেছেন তা-ই মেট্রিক্স সংগঠন ।
দ্রব্য ও কার্যভিত্তিক বিভাগীয়করণের সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন কাঠামোকে মেট্রিক্স সংগঠন বলে । দ্রব্যভিত্তিক বিভাগীয়করণের ক্ষেত্রে প্রতিটা দ্রব্য ও সেবার জন্য যেভাবে আলাদা বিভাগ ও বিভাগীয় ম্যানেজার কর্মরত থাকে এক্ষেত্রেও প্রতিটা দ্রব্য বা সেবাকে আলাদা প্রজেক্ট ধরে তার জন্য একেকজন প্রজেক্ট ম্যানেজার নিয়োগ করা হয় । অন্যদিকে উৎপাদন, বিপণন, ক্রয়, মানবসম্পদ ইত্যাদি কার্যভিত্তিক বিভাগগুলো একইভাবে কর্মরত থাকে। এক্ষেত্রে কার্যভিত্তিক বিভাগগুলোর ব্যবস্থাপকদেরকে কার্যিক (Functional) ব্যবস্থাপক বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে প্রজেক্ট ব্যবস্থাপকগণ তাদের স্ব স্ব দ্রব্য বা প্রজেক্টের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকেন । কার্যিক ব্যবস্থাপকগণের কাজ হয় প্রজেক্ট ব্যবস্থাপকগণের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন, বন্টন ও আনুষঙ্গিক কাজে সহায়তা করা । এ ধরনের সংগঠনে সাধারণ বা মহাব্যবস্থাপক কার্যত মেট্রিক্স ব্যবস্থাপক হিসেবে গণ্য হন। তার অধীনে একদিকে থাকে বিভিন্ন কার্যিক ব্যবস্থাপক ও অন্যদিকে প্রজেক্ট বা দ্রব্য ব্যবস্থাপকগণ । এ কারণে একে Two Boss Employees পদ্ধতির সংগঠন কাঠামোও বলা হয়ে থাকে । উভয় ধরনের ব্যবস্থাপকই মহা-ব্যবস্থাপকের নিকট দায়ী থাকেন। উভয়ের পারস্পরিক চেষ্টা, সমন্বয় ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আপনা-আপনি কাজের মধ্যে এক ধরনের গতির সঞ্চার হয় । কার্যক্ষেত্রে কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা মেট্রিক্স ব্যবস্থাপকের কাছে যায় এবং তিনি সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এতে মেট্রিক্স ম্যানেজারকে অবশ্যই যোগ্য ও অধস্তনদের ওপর যথেষ্ট প্রভাবশালী হতে হয় । ১৯৬০ এর দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের এ্যারোস্পেস কোম্পানিতে সফল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে এ সংগঠন যাত্রা শুরু করে । নিম্নে রেখাচিত্রের সাহায্যে এরূপ সংগঠন কাঠামো তুলে ধরা হলো:
মেট্রিক্স সংগঠনের বৈশিষ্ট্য :
১. এটি হলো কার্যভিত্তিক ও দ্রব্যভিত্তিক বিভাগীয়করণের মিশ্রণ;
২. এক্ষেত্রে দু'ধরনের ব্যবস্থাপক একই সঙ্গে কাজ করে; যথা- কার্যিক ব্যবস্থাপক ও প্রজেক্ট ব্যবস্থাপক;
৩. কার্যিক ব্যবস্থাপকের কাজ হলো প্রজেক্ট ব্যবস্থাপকের চাহিদামতো জনশক্তি, উপায়-উপকরণ ও সেবা সরবরাহ করা;
৪. প্রজেক্ট ব্যবস্থাপক বিশেষ দ্রব্য বা প্রজেক্টের সামগ্রিক দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং যার জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে;
৫. উভয় ধরনের ব্যবস্থাপকদের চেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর এরূপ সংগঠনের সফলতা নির্ভর করে এবং
৬. উভয় ধরনের ব্যবস্থাপক একযোগে প্রজেক্ট ম্যানেজার বা সাধারণ ব্যবস্থাপকের নিকট দায়ী থাকে ।
আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বৃহদায়তন ব্যবসায় পরিমণ্ডলে প্রচলিত সাংগঠনিক কাঠামোসমূহের ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ১৯৬০ সালের পর থেকে মেট্রিক্স সংগঠন কাঠামোর ব্যবহার শুরু হয় । এর পর থেকে আধুনিক বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক কোম্পানিসমূহে তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে । এ ধরনের জনপ্রিয়তার পরও মেট্রিক্স সংগঠন সর্বত্র ব্যবহার করা যাচ্ছে তা নয় । এছাড়া বেশ কিছু অসুবিধাও এর কার্যকারিতাকে ক্ষেত্রবিশেষে বাধাগ্রস্ত করে । নিম্নে এরূপ সংগঠনের সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. নির্বাহীগণের দক্ষতা বৃদ্ধি (Increasing efficiency of the executives) : এক্ষেত্রে প্রজেক্ট পর্যায়ে ও কার্যক্ষেত্রে নিযুক্ত ব্যবস্থাপকগণ যথেষ্ট কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ভোগ করেন এবং উচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থাপকগণের অনুমোদনসাপেক্ষে নিজেরাই অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন । ফলে নির্দিষ্ট প্রজেক্ট বা ব্যবসায় পর্যায়ের (Business level) নির্বাহীরা অধিক দক্ষতা অর্জন ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সূযোগ পায় ।
২. সহযোগিতার উন্নয়ন (Developing co-operation) : এক্ষেত্রে অঞ্চল, প্রজেক্ট, দ্রব্য বা ব্যবসায়ের দায়িত্বে নিযুক্ত নির্বাহী যেমনি তার প্রজেক্টের জন্য উচ্চ পর্যায়ের নির্বাহীর (CEO) কাছে দায়ী থাকেন তেমনি উক্ত প্রজেক্টের প্রতিটা কাজ সম্পাদনের জন্য কার্যভিত্তিক নির্বাহীগণ প্রজেক্ট নির্বাহীকে সহযোগিতা প্রদান করেন । ফলে ব্যবসায় পর্যায়ে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠে ।
৩. কার্যকর সমন্বয় প্রতিষ্ঠা (Establishing effective co-ordination) : মেট্রিক্স সংগঠন প্রতিষ্ঠানে সমান্তরাল সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। একটা প্রজেক্টকে কার্যিক ব্যবস্থাপকগণ পাশাপাশি থেকে সহযোগিতা করেন । উৎপাদন বিভাগের নির্বাহী সফল হলেও যদি বিপণন বিভাগের নির্বাহী সফল না হয় তবে সামগ্রিকভাবে প্রজেক্ট ব্যবস্থাপক দায়ী হয় এবং তার সাথে অন্যরাও সেজন্য ঊর্ধ্বতনের (CEO) নিকট দায়ী থাকে । ফলে বাধ্য হয়েই একে অন্যের সাথে কাজের সমন্বয় করে ।
৪. উচ্চ নির্বাহীগণকে সহায়তা দান (Providing assistance to chief executives) : এরূপ সংগঠনে উপরিস্তরের (Corporate level) নির্বাহীগণকে প্রজেক্ট লেভেল দেখার জন্য তেমন সময় ব্যয় করতে হয় না। উন্নত তথ্য প্রযুক্তির কারণে তার নিকট সকল প্রজেক্টের সর্বশেষ তথ্য থাকে । প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র তাকে প্রজেক্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান বা হস্তক্ষেপ করতে হয় । ফলে তাঁর বা তাঁদের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হয় ।
৫. প্রতিভা ও দক্ষতার সমন্বয় (Co-ordination between intelligence and efficiency) : এ ধরনের সংগঠন কাঠামোতে বহুমুখী প্রতিভা, অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা একত্রিত হয় । উন্নত প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে প্রতিভা ও যোগ্যতাকে কাজে লাগানো সহজ হয় । এতে যে কোন জটিল সমস্যা সহজে সমাধান করে এগিয়ে যাওয়া যায় ।
১. প্রশাসনিক খরচ বৃদ্ধি (Increasing administrative cost) : এরূপ সংগঠন কাঠামোতে কার্যভিত্তিক বিভাগীয় ব্যবস্থাপকগণের সাথে প্রতিটা প্রজেক্টের জন্য পৃথক ব্যবস্থাপক ও সংশ্লিষ্ট কর্মী কর্মরত থাকায় প্রশাসনিক ব্যয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ।
২. দ্বৈত কর্তৃত্বের বিপদ (Danger of dual authority) : এরূপ সংগঠনে প্রজেক্ট ব্যবস্থাপক, কার্যভিত্তিক ব্যবস্থাপক এবং ক্ষেত্রবিশেষে আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকগণ পাশাপাশি কর্মরত থাকেন । এতে কোনো সমস্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মতামত প্রদানে দ্বৈত কর্তৃত্বের সৃষ্টি হয় । যা ক্ষেত্রবিশেষে সমস্যার সৃষ্টি করে ।
৩. দ্বন্দ্ব সৃষ্টি (Making conflict) : এ ধরনের সংগঠন কাঠামোতে একই সমান্তরালে কার্যভিত্তিক ব্যবস্থাপক ও প্রজেক্ট ব্যবস্থাপকগণ কাজ করায় একে অন্যকে কোনো নির্দেশ দিতে বা বাধ্য করতে পারে না । তাই কোনো কারণে একবার ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হলে তা দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। এমন অবস্থায় প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় মারাত্মক জটিলতা দেখা দেয় ।
৪. দলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমস্যা (Problem in taking group decision) : এ ধরনের সংগঠনে একটা সাধারণ সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও সমান্তরাল পর্যায়ে কর্মরত ব্যবস্থাপকগণ দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেন । প্রতিটা বিষয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে যেয়ে ঝামেলার পাশাপাশি সময় নষ্ট ও নানান ধরনের জটিলতা লক্ষ করা যায় ।
৫. পরিবর্তনে সমস্যা (Problem in change) : এরূপ সংগঠনে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনতে হলে সে ধরনের সিদ্ধান্ত কর্পোরেট লেভেল বা উচ্চ পর্যায় থেকে নিতে হয় । সেক্ষেত্রে যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোনো দুর্বলতা বা নিচের পর্যায়ের নির্বাহীগণের দক্ষতায় অভাব থাকলে এরূপ পরিবর্তনের সাথে দ্রুত সাড়াদান তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না ।
একটা প্রতিষ্ঠানের কাজকে সুষ্ঠুভাবে বিভাজন করে বিভিন্ন বিভাগ ও উপবিভাগ সৃষ্টি, প্রতিটা বিভাগ ও উপবিভাগের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণ এবং ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত একের সাথে অন্যের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কাজ সংগঠন নামে পরিচিত । এরূপ সম্পর্ক সৃষ্টির ফলে তা নিঃসন্দেহে একটা কাঠামোর রূপ লাভ করে । যেখানে শীর্ষ পর্যায়ে একজন মুখ্য নির্বাহী থাকেন এবং তা যতই নিচের দিকে বিস্তৃত হয় ততই তা একটা পিরামিডের রূপ লাভ করে । এরূপ কার্য বিভাজন, দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণ ও সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ভুল হলে বাহ্যিক দিক থেকে তা অনেক সময় বোঝা না গেলেও কার্য পরিচালনায় যেয়ে ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ে। যা সংশোধন কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায় । বিষয়টি ইঞ্জিন তৈরি বা সংযোজনের মত । স্টার্ট দিলেই ধরা পড়ে তা কতটা যথার্থ । ক্লাব সংগঠনের কাঠামো দিয়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চলে না । ছোট প্রতিষ্ঠানের কাঠামোতে বড় প্রতিষ্ঠান চালানো যায় না । উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠান চালাতে সংগঠন কাঠমোকে সেভাবেই গড়ে তুলতে হয়। তাই এরূপ কাঠামো গড়তে এর উদ্যোক্তা বা শীর্ষ নির্বাহীদের নানান বিষয় গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার প্রয়োজন পড়ে । নিম্নে এরূপ বিবেচ্য বিষয়সমূহ তুলে ধরা হলো:
১. উদ্দেশ্য (Objectives) : সংগঠন কাঠামো প্রণয়ন করার পূর্বে প্রতিষ্ঠানকে তার উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে হয় অতঃপর উদ্দেশ্য বিবেচনায় নিয়ে যথাযথভাবে কার্যবিভাজন এবং প্রয়োজনীয় বিভাগ ও উপবিভাগ খুলতে হয় । একটি ক্লাবের সংগঠন কাঠামো তার উদ্দেশ্যের কারণেই এক ধরনের হয় । উৎপাদনধর্মী প্রতিষ্ঠানের সংগঠন কাঠামোও উদ্দেশ্য বিবেচনায় ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে ।
২. দক্ষতা (Efficiency) : সংগঠন কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা আবশ্যক যাতে ন্যূনতম সামর্থ্য ও অর্থ ব্যয়ে পূর্ব পরিকল্পিত লক্ষ্যসমূহ অর্জন করা যায়। এক্ষেত্রে প্রতিটি উপাদান যাতে দক্ষতার সাথে কার্য সম্পাদন করতে পারে সংগঠন কাঠামো প্রণয়নে তা নিশ্চিত করারও প্রয়োজন পড়ে। একজন উর্ধ্বতনের সরাসরি কর্তৃত্বাধীন এমন সংখ্যক অধস্তন রাখা উচিত যাদের কাজকে তিনি সুষ্ঠুভাবে তদারক করে নিজস্ব দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন ।
৩. নির্দিষ্টতা (Specification) : সংগঠনের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মচারীর স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত । এ ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কতটুকু তাও স্পষ্ট থাকতে হবে। এজন্য প্রত্যেকটি বিভাগ, উপবিভাগ ও ব্যক্তির কাজকে সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন । প্রত্যেকের দায়িত্ব-কর্তৃত্বও সঠিকভাবে চিহ্নিত করা দরকার। সংগঠন কাঠামো প্রণয়নের সময় এ বিষয়টি বিশেষভাবে নজরে রাখা একজন সংগঠকের কর্তব্য ।
৪. বিশেষজ্ঞতা (Specialization) : সংগঠন কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা উচিত যাতে এর প্রত্যেক ব্যক্তি, বিভাগ ও উপবিভাগ বিশেষজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায় । এ জন্য কার্যাদি এমনভাবে ভাগ করা প্রয়োজন যাতে একজন কর্মীকে একটিমাত্র কাজই করতে হয় বা একটি বিভাগ একই ধরনের কার্য সম্পাদন করে । আর এটা সম্ভব হলে ব্যক্তি বা বিভাগের পক্ষে ঐ কাজে বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব হয়ে থাকে ।
৫. ভারসাম্য (Balancing) : সংগঠনের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের সকল বিভাগ ও উপবিভাগের কার্যাবলির মধ্যে যতদূর সম্ভব সমতা ও ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত। কোনো বিভাগের কাজ বেশি হলে সেখানে বেশি জনশক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন । আবার কাজের পরিমাণ কম হলে জনশক্তিও কম রাখা দরকার । এমন যেনো না হয় যে কোনো বিভাগ বা এর কর্মীদের কাজ নেই আবার কোনো বিভাগের কর্মীরা কার্যভারগ্রস্ত ।